ফিলিস্তিনের পক্ষে ৭ ক্ষমতাধর দেশ
চলমান এই যুদ্ধ নিয়ে পক্ষ ও বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেছে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো। ইতোমধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর বেশিরভাগ ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: কোনোপ্রকার ইশারা ইঙ্গিত ছাড়াই শনিবার (৭ অক্টোবর) অবরুদ্ধ গাজা থেকে ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। হামাসের এমন হঠাৎ হামলার জবাবে গাজায় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। টানা এক সপ্তাহ বিমান হামলার পর এখন ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ২ হাজার ২১৫ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৮ হাজার ৭১৪ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা ১৩০০ জন এবং আহত হয়েছে তিন হাজার ৪০০ জনের বেশি।
তবে চলমান এই যুদ্ধে বিশ্বের বেশ কয়েকটি পরাশক্তি ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েকটি শক্তিধর দেশ দ্বিরাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্তিধর যেসব দেশ দাঁড়িয়েছে সে দেশগুলোর কথা জানা যাক-
ভারত
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে প্রথমে ভারত প্রথমে যে দুইটি বিবৃতি দেয় সেখানে ফিলিস্তিন শব্দটি অনুপস্থিত ছিল। হামাসের হামলার পর নিজের অফিসিয়াল এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে একটি টুইট করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টুইটে হামাসের হামলার নিন্দা এবং এমন কঠিন মুহূর্তে ইসরায়েলের পাশে থাকার কথা জানান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলার খবরে বিস্মিত হয়েছি। নিরীহ নিহত মানুষ ও তাদের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা এবং সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। এমন কঠিন মুহূর্তে আমরা ইসরায়েলের পক্ষে আছি।’ মঙ্গলবার টেলিফোনে বেনজামিন নেতানিয়াহুকে মোদি বলেন, ভারত সন্ত্রাসীদের বিপক্ষে রয়েছে এবং সুদৃঢ়ভাবে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, ভারত সরকারের ইসরায়েলকে এমন দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কারণে সুধীসমাজ ও বিরোধী দলে সমালোচনার সূত্রপাত ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার ভারত তার বক্তব্যে কিছুটা পরিবর্তন আনে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সম্পর্কে ভারত সচেতন উল্লেখ করে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেন, ‘ফিলিস্তিন- ইসরায়েল ইস্যুতে ভারতের নীতি অনেক পুরোনো। ভারত ইসরায়েলের পাশে রয়েছে। সেই সঙ্গে দেশটি নিরাপদ ও স্বীকৃত সীমানার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি সার্বভৌম, স্বাধীন ও কার্যকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।’
এনডিটিভি আরও জানায়, আরব দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত ইরাক থেকে প্রচুর পরিমাণে তেল আমদানি করে থাকে। এ ছাড়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও তেল কেনাবেচার সম্পর্কে আবদ্ধ ভারত। যদি ভারতের সঙ্গে আরব দেশগুলোর তেল আমদানির সম্পর্কে ভাটা পড়ে তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বাড়বে ঠিকই, তবে তা যথেষ্ঠ হবে না।
ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ ভারত। ১৯৭৪ সালে ভারত প্রথম অ-আরব রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে ফিলিস্তিনিদের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে এবং ১৯৮৮ সালে পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৬ সালে সুষমা স্বরাজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন দুই দেশ দেশের উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। ২০১৭ সালে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ভারত সফরে আসেন। ২০১৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সে সফরের জবাবে ফিলিস্তিন ভ্রমণ করেন এবং শান্তিময় পরিবেশে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ১৯৭৭ সালে ভারতের প্রয়াত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজন অটল বিহারি বাজপাই বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকট নিরসনে ইসরায়েলকে অবশ্যই ফিলিস্তিনি ভূমি ছেড়ে দিতে হবে যা তার অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। সম্প্রতি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে তার বক্তব্যের ভিডিওটি নতুন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
চলমান সংকটে ভারতের দুই প্রতিক্রিয়া দেশটির ভারসাম্য রক্ষার নীতির কথাই মনে করে করিয়ে দেয়। ২০২১ সালে যখন হামাস রকেট হামলা চালায় এবং ইসরায়েলের পালটা জবাব দেয় তখন প্রায় ৩০০ জন প্রাণ হারায়। তখনও ভারত দুই পক্ষের সমালোচনা করেছিল।
চীন
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মূল কারণ ফিলিস্তিনের প্রতি ঐতিহাসিক অবিচার বলে মন্তব্য করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফরেন পলিসিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের সাথে আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের মূলে রয়েছে ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্ব। ঐতিহাসিক এ অবিচারের কারণে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগে ফেলা কোনোভাবেই সঠিক ছিল না।
চীনের এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় তেল আবিব। বেইজিংয়ে নিযুক্ত ইসরায়েলের দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইউভাল ওয়াকস বলেন, তারা চীন থেকে হামাসের এ হামলার বিষয়ে কঠোর নিন্দার আশা করেছিল। কেননা চীনকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে দেখে ইসরায়েল।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই বেইজিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের কথা উঠে আসে। এ সময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অবিলম্বে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দুপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তবে তিনি স্পষ্ট ভাষায় এও বলেছেন, দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই এ চলমান সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার উপায়।
চীনের এই বক্তব্যে হতবাক ইসরায়েল। তারা ভেবেছিল হামাসের হামলার কঠোর নিন্দা জানাবে চীনারা। বেইজিংয়ে ইসরায়েলি দূতাবাসের সিনিয়র কর্মকর্তা ইউভাল ওয়াকস বলেছেন, রাস্তায় গরুর মতো মানুষকে জবাই করা হচ্ছে, এখন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের ডাক দেওয়ার সময় নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরিভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্যে চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ইরান
ইসরায়েলে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিবাদন জানায় ইরান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির এক উপদেষ্টা শনিবার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বিগত বছরগুলোতে সবচেয়ে বড় হামলা করায় অভিবাদন জানান। রাহিম সাফাভি নামের ওই উপদেষ্টা বলেন, আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের স্বাগত জানাই। যতক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের স্বাধীনতা অর্জন হচ্ছে না, আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাশে থাকতে চাই।
এ ছাড়াও সংবাদমাধ্যম ইরনার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ও অর্জনকে স্বাগত জানিয়ে শনিবার ইরানের রাজধানী তেহরানের পাশাপাশি মাশহাদ, তাব্রিজ ও জাঞ্জান শহরের সড়কে নেমে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করেছেন।
এমনকি ইসরায়েলে অকস্মাৎ হামলার পেছনে ইরানের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল চলমান সংঘর্ষে ইরানের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন হামাসের ভয়াবহ হামলার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে ইরান।
মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এক বছর আগে থেকেই হামাসের এ হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইরান হামাসকে সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং অন্যান্য সহযোগিতা করেছে। এসব কাজে ব্যয় করা হয়েছে মিলিয়ন ডলার। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে এ আক্রমণের বিষয়ে হামাস এবং ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে গত সপ্তাহে বৈঠক হয় বলে জানায় গণমাধ্যমটি।
এসব বৈঠকে ইরানের আইআরজিসির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে হামাস ও হিজবুল্লাহসহ ইরান সমর্থিত চার সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। হামাস ও হিজবুল্লাহ সদস্যদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহ এসব বৈঠকের অন্তত দুটিতে অংশ নিয়েছেন।
রাশিয়া
সংঘাত সমাধানের জন্য ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া। গত সোমবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ হামাস-ইসরায়েল সংঘাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ আহ্বান জানিয়েছেন।
মস্কোতে আরব লিগের প্রধান আহমেদ আবুল আহমেদ আবুল ঘেইতের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের আলোচনাই এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়। কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সেদিকেই বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। এর আগে একই দিনে রাশিয়ার মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের বর্তমান সংঘাতের পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক বিস্তৃত হতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। যার কারণে এটি আজ আমাদের বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়েছে রাশিয়া। এতে হামাসের বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা প্রস্তাব পাস করতে পারেনি সংস্থাটি।
এদিকে ভ্লাদিমির পুতিন মঙ্গলবার ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানির সাথে বৈঠকে বলেন, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সহিংসতার যে বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে তা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির ব্যর্থতার উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করছে।
তুরস্ক
জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ও ভৌগোলিকভাবে একীভূত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রোববার (৮ অক্টোবর) তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় এফ্রেম সিরিয়ার প্রাচীন অর্থোডক্স চার্চ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আল-আকসা মসজিদের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রচেষ্টার বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে তুরস্ক।’ চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধ করতে, ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা কমাতে তুরস্ক তার ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত। এর আগে শনিবার ক্রমবর্ধমান সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনকে সংযমের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে তুরস্ক।
এরদোয়ান আরও বলেন, ইসরায়েলে যা হয়েছে তারপর আমি বলতে চাই আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে আর সংঘাত বাড়ে। এ দুপক্ষকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানাই।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধের বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন তুরস্ক। এ অঞ্চলে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে এরদোয়ান চলমান সংকট নিয়ে তিনি কাতারের শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-থানি, সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-ফুরহান আল-সৌদ, মিসরের সামেহ শউকরি, ফিলিস্তিনির রিয়াদ আল-মালিকি এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরদোয়ান বলেছেন, বিশ্ব অব্যাহত সংঘাত ও ট্র্যাজেডি সহ্য না করলেও সাম্প্রতিক ঘটনায় মানবসমাজ ভালো নজির স্থাপন করেনি। ফিলিস্তিন ইস্যু হলো সমগ্র বিশ্ব, বৈশ্বিক শাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার মর্যাদার ইস্যু। এই ইস্যুতে বিশ্বের সব প্রতিষ্ঠানের দায় রয়েছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার কোনো প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা ফিলিস্তিনি জনগণকে একা ছেড়ে দিয়েছে। তারা ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী যেসব কুশীলব নীরবতার পরিবর্তে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন আমরা দুঃখের সঙ্গে তাদের মনোভাবকে স্বাগত জানাই। এই সংঘাতের দুই পক্ষ নিয়ে যেন আমেরিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলো ন্যায়, ন্যায্য ও মানবিক মনোভাব গ্রহণ করে, আমরা সে আহ্বান জানাই৷ ফিলিস্তিনি জনগণকে শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে মানবিক সহায়তা বন্ধ করার মতো সাম্রাজ্যবাদী সিদ্ধান্ত থেকে সবার বিরত থাকা উচিত।
তিনি বলেন, অন্ধভাবে একপক্ষ নিলে বর্তমান সংকট আরও গভীর হবে। এ জন্য তুরস্কের পক্ষ থেকে আমরা সব পক্ষকে আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা চাই এই অঞ্চলে যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ হোক এবং সব পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হোক। তুরস্কের পক্ষ থেকে আমরা সবকিছু প্রস্তুত রয়েছি।
সৌদি আরব
ফিলিস্তিনের গাজাভিত্তিক স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর চলমান যুদ্ধ নিয়ে এবার মুখ খুললেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সালমান চলমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ফোন করেছেন। ক্রাউন প্রিন্সের অফিসে থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান সংঘর্ষে সৌদি ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকবেন বলে জানিয়ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
এই ফোনে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, ‘চলমান উত্তেজনা প্রশমনে সকল আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পক্ষগুলোকে সম্পৃক্ত করার জন্য সম্ভব সকল প্রয়াস চালাচ্ছে’ সৌদি আরব।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়- তিনি বলেছেন, সৌদি আরব ‘ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার অর্জন, সম্মানজনক জীবন লাভের সংগ্রামে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে এবং ন্যায়সংগত ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে থাকবে।’
নতুন খবর হলো, ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধের জেরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ স্থগিত করেছে সৌদি আরব। এ তথ্য জানিয়েছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি। গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বহুল আলোচিত বিষয়—যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নিপ্রধান মুসলিম রাষ্ট্র সৌদি আরবের শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, তেলআবিবের সঙ্গে শান্তিচুক্তির বিনিময়ে সৌদির নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বড় আকারের নিশ্চয়তা চায় রিয়াদ। এমনকি এ কারণে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিও ছাড় দিতে রাজি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
তবে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। হামাসের হামলার পর প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরব। ইসরায়েলের নাম উল্লেখ না করে এ সহিংসতার জন্য দেশটিকে দায়ী করেছে সৌদি প্রশাসন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে রিয়াদ।
সৌদি-ইসরায়েল চুক্তি আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এএফপিকে বলেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি আরব। বিষয়টি তারা মার্কিন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছে। বর্তমানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও রিয়াদ সফর করছেন।
উত্তর কোরিয়া
হামাস ও ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা আগেই জানিয়েছে বিশ্বের দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া। এবার তাদের সঙ্গে যোগ দিল পরমাণু শক্তিধর আরেক দেশ উত্তর কোরিয়া। দেশটি বলছে, গাজায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের জন্য ইসরায়েল দায়ী। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই দীর্ঘদিনের এই সংঘাত সমাধানের প্রধান পথ। মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
উত্তরের ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির মুখপত্র রোডং সিনমুন বিদেশি গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থায় একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ লিখেছেন। রোডং সিনমুন বলেছেন, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অব্যাহত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ফলই এই সংঘাত। এ সংঘাত সমাধানের প্রধান উপায় হলো স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
এর আগে গাজা ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান জানায় চীন ও রাশিয়া। দুই রাষ্ট্রই ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংকটে মানুষের প্রাণহানি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীন রাশিয়া উভয়ই দ্বিরাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বিবৃতি দেয়।
এছাড়া পাকিস্তান, কাতার, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের অবস্থান প্রকাশ করেছে।