রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আস্থা তৈরির পদক্ষেপ প্রয়োজন

চলমান রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।  সাক্ষাৎকারটি হুবুহু তুলে ধরা হলো।

রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আস্থা তৈরির পদক্ষেপ প্রয়োজন

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: চলমান রাজনৈতিক সংকট বা অবস্থার উত্তরণে এই মুহূর্তে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘কনফিডেন্ট বিল্ডিং মেজার’ বা আস্থা তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ। এছাড়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘এক ধরনের সহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গির কিছু পরিচয় তৈরি করা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। চলমান রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা। 

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘এক ধরনের সহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গির কিছু পরিচয় তৈরি করা খুবই প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে ‘কনফিডেন্ট বিল্ডিং মেজার’ অথবা আস্থা তৈরির পদক্ষেপ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের প্রয়োজনগুলো উদার দৃষ্টিতে দেখা সেই আস্থা তৈরির পদক্ষেপের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। এটা মানবিক দৃষ্টি তো বটেই তার বাইরেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলবো যে আস্থা তৈরির পদক্ষেপের মধ্যে এটি একটি পদক্ষেপ হিসেবে সরকার এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী কিন্তু বিবেচনা করতে পারেন।

তাহলে বিবদমান দলগুলোকে নিয়ে ভিন্ন ধরনের একটি পরিবেশ তৈরি হতে পারে। যেখানে আমরা একটি সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে সহিংসতা পরিহার করে রাজনৈতিক সুস্থ টেকসই সমাধানের দিকে এগোতে পারবো। এর জন্য আস্থা তৈরির পরিবেশটা কিন্তু অত্যন্ত জরুরি। আমি বলবো অন্তর্বর্তীকালীন একটি বিষয়। এবং সেখানে বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ সেবা নিশ্চিত করে একটি উদার সমাধান হিসেবে উদাহরণ হতে পারে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলে নয়, যে কোনো মানুষের সুস্বাস্থ্য-স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা তো আমাদের সংবিধানের মধ্যেই আছে। এক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটি বাস্তবতা হচ্ছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে চরম একটি বিশ্বাসের ঘাটতি। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমি চারটি বিষয় হাইলাইটস করতে পারি। একটি হচ্ছে পারিবারিক অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের বিষয় আছে তেমনি রাষ্ট্রেরও আয়-ব্যয়ের বিষয় আছে। এখানে জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থা ‘পাবলিক ফিন্যান্স’ অত্যন্ত একটি সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে।

রিজার্ভ সবসময় ব্যবহার হয় আবার এটা পূরণও হয়। এখন রিজার্ভ ব্যবহার হচ্ছে কিন্তু এটাকে পূরণ করার কাজটি ওভাবে হচ্ছে না। আমরা এক অর্থে বলতে পারি যে রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের একটি বড় ধরনের সংকট এই মুহূর্তে চলছে। যার প্রভাব নানান ক্ষেত্রে পড়ছে। আরেকটি দিক হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টের একটি জায়গায় রয়েছে। তাদের কষ্টটা আরও বাড়ছে। শুধু দরিদ্র নয় মধ্যবিত্তরা এই কষ্টের মধ্যে পড়ছে। এগুলো হচ্ছে এই মুহূর্তের একটি সমস্যা। কিন্তু আমাদের যে সমস্যার মধ্যে উত্থান-পতন হতে পারে তা হলো টেকসই উন্নয়নের চলার পথ। সেটার যে কৌশলগুলো আছে সেগুলো এখন আর কার্যকর হচ্ছে না।

যার ফলে আমাদের সংকটটি শুধু এই মুহূর্তের নয়। যেটাকে ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’ বলা যেতে পারে। এগুলো যে হচ্ছে তার মধ্যে অনেকগুলো কারণ আছে। কিন্তু অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পলিসি রিজিম অর্থাৎ আমাদের নীতি কাঠামো। এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনার যে রাজনৈতিক শাসনের বাস্তবতা তার মধ্যে থেকেই কিন্তু এই সংকটগুলো তৈরি হয়েছে। 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী যে গোষ্ঠী রয়েছে তাদেরকে আমরা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারছি না। এবং আনার ইচ্ছাও সেভাবে দেখছি না। আবার রাষ্ট্রীয় যে সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি এগুলোকে কার্যকরভাবে আমরা দেখছি না। রাষ্ট্রীয়ভাবে যারা অর্থনীতিকে পরিচালনা করছেন তাদের মধ্যে দুটো সমস্যা দেখা যায়। একটি হচ্ছে সমস্যা নেই এ ধরনের একটি মনোভাবের মধ্যে ডুবে থাকা। এবং শেষ মুহূর্তে কিছু একটা করে এটাকে উতরানোর চেষ্টা। দ্বিতীয় হচ্ছে-রঙিন চশমা পরে বসে থাকা। আমরা যারা রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করছি তারা এক ধরনের বাস্তবতা দেখছি। আর যারা রঙিন চশমা পরে আছেন তারা দেখছেন-সবকিছু উন্নত হয়েছে। চারদিকে সবই ভালো। কোনো সমস্যা নেই।

এই কারণেই সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা মানুষের যে দৈনন্দিন জীবনমানের সমস্যা এবং মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার যে সম্ভাবনার বিষয় এগুলো শুধুমাত্র একটি অর্থনীতির সাধারণ নিয়মাবলির মাধ্যমে হচ্ছে তা নয়। এর অন্যতম একটি কারণ ‘যেভাবে অর্থনীতি রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হচ্ছে তার থেকে এই বিষয়গুলোর উৎপত্তি হচ্ছে। সেজন্য এখন আমরা সংকটের মধ্যে আছি। এবং এটা থেকে উত্তরণের জন্য অন্যতম যেটা প্রয়োজন তা হলো ‘অর্থনীতির পরিচালনার যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তার একটি আমুল পরিবর্তন। এবং অর্থনীতি পরিচালনা টিমেরও পরিবর্তন দরকার। এগুলো না হলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনাগুলো অধরাই থাকবে। 

তিনি বলেন, একদিকে মেগাপ্রকল্পসহ উন্নয়নের জোয়ার, আরেক দিকে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস। উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। মেগা প্রকল্প অবশ্যই নিতে হবে। কিন্তু সেগুলো আমাদের খরচের দক্ষতার মাধ্যমে হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে। এক ধরনের বেহিসাবি-উচ্ছৃঙ্খল খরচের মাধ্যমে এগুলো হচ্ছে। অন্যান্য অনেক জায়গায় বেহিসাবি-উচ্ছৃঙ্খল খরচ হচ্ছে বলেও আমরা দেখছি। এই মুহূর্তে অর্থনীতির বহুমাত্রিক সংকট আছে। অথনীতি পরিচালনার যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা কর্তৃত্বের থেকে হচ্ছে তাদের চিন্তাধারা-কৌশল, গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার প্রবণতা এসব কারণেই কিন্তু সংকটগুলো তৈরি হচ্ছে। এসব স্থানে পরিবর্তন না হলে সংকটগুলো টেকসইভাবে উত্তরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না।