রাষ্ট্র চরম বিপর্যয়ের নিকটবর্তী

এখানে যে অপরাধী সে দণ্ডিত নয়, সে সমাজে সম্মানের মুকুট মাথায় দিয়ে গর্ব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর যে দণ্ডিত সে অপরাধী নয়।

রাষ্ট্র চরম বিপর্যয়ের নিকটবর্তী

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: অগণিত প্রাণের বিনিময়ে এবং মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি হওয়ার কথা ছিল গণতান্ত্রিক এবং নৈতিকভাবে আলোকিত বা আদর্শিক রাষ্ট্র। অথচ এখানে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পুঞ্জীভূত করা যায়, সংবিধানকে ইচ্ছাধীন করে রাষ্ট্রকে ব্যক্তিগত বিবেচনায় পরিচালনা করা যায়, অতি দ্রুত ধনী হওয়া যায়, ব্যক্তিগত ধনাগার তৈরি করা যায়-এই রাষ্ট্রকে আর প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। এখানে যে অপরাধী সে দণ্ডিত নয়, সে সমাজে সম্মানের মুকুট মাথায় দিয়ে গর্ব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর যে দণ্ডিত সে অপরাধী নয়। সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করলেই গায়েবি মামলা দিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধীকে অপরাধী হিসেবে সাজা দেয়া যায়, বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখা যায়, বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা যায়। 

সংবিধানের প্রস্তাবনায় অঙ্গীকার করা হয়েছিল- ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ কিন্তু সেই ঘোষিত নৈতিক আদর্শকে আমরা পরিত্যক্ত করে ফেলেছি, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রের প্রতি আমরা অনুগত নই। ফলে ৫৩ বছর পর রাষ্ট্র চিহ্নিত হচ্ছে ‘অপরাধপ্রবণ’ রাষ্ট্র হিসেবে। জাতির চরিত্রে এর চেয়ে বড় ক্ষতচিহ্ন আর কিছু হতে পারে না।

রাষ্ট্রে অপরাধী নিরাপদ থাকে, অপরাধীকে রাষ্ট্র সুরক্ষা দেয়। অপরাধীরাই পদ এবং ক্ষমতার দাপটে অবৈধ কর্মকাণ্ডকে আইনানুগ করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে অবিরাম অন্যায়-অপরাধ এবং  অন্যায্যতাকে প্রশ্রয় দেয়। গণতন্ত্রের সর্বজনীন নীতিকে উপেক্ষা করে ক্ষমতাকে নবায়িত করার সরকারের কৌশলকেই নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিরোধী দলের জন সমাবেশে আক্রমণ করার এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করার বেআইনি কর্মকাণ্ডকে নিরাপত্তার নামে সরকার বৈধতা দেয়।

প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী, যিনি ধাপে ধাপে পুলিশের মহাপরিদর্শক হয়ে রাষ্ট্রের উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন কিছুদিনের জন্য। যার আর্থিক উৎস হচ্ছে- বেতন-ভাতা, টিএডিএ, বোনাস বা উৎসব ভাতা, বিদেশ ভ্রমণ ও ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ ভাতা। চাকরি শেষে এককালীন পেনশনের টাকা। এতে যাপিত জীবন ভোগ-বিলাসী না হলেও ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা আছে। এ ছাড়া অনুপার্জিত টাকা অর্জনের কোনো সুযোগ রাষ্ট্র দেয়নি। 

প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী চাকরিরত অবস্থায় কয়েক হাজার বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। ফ্ল্যাট, বাড়ি, কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করেছেন। অথচ রাষ্ট্রের কোনো সংস্থার চোখে পড়লো না! দেশে সরকার আছে, গোয়েন্দা সংস্থা আছে, আদালত আছে, গণমাধ্যম আছে- কারও চোখে পড়লো না কেন?  দুর্নীতি দমন কমিশন কি বিদ্যমান ছিল না? সরকারের কাছে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এই ভয়াবহ দুর্নীতির রিপোর্ট উত্থাপন করেনি? এতেই কি প্রমাণ হয় না আমাদের প্রাণের রাষ্ট্র কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মাঝে আছে! এতে কি প্রমাণ হয় না একটি রাষ্ট্রকে কী ভয়ঙ্কর ভয়ভীতির মাঝে নিক্ষেপ করা হয়েছে!  চাকরিরত অবস্থায় কোনো গণমাধ্যম আইজিপি’র দুর্নীতির বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করারও সাহস পায়নি।

স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডি ব্যবসা, মাদক ব্যবসা-সহ আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের সদস্য হয়েও আনোয়ারুল আজিম বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনবার! এতে কি প্রমাণ হয় না, রাষ্ট্র চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। একজন সাবেক সেনাপ্রধান যখন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে বৈশ্বিক পরাশক্তির নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত হন, তখন কি মনে করতে পারি না, আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছি। এসব নজির বিরল কিন্তু এর রাজনৈতিক ফলাফল খুবই বিরূপ। সকল অপকর্মকে মুক্তিযুদ্ধের আবরণ দিয়ে ঢাকতে গিয়ে রাষ্ট্রটাকেই জনগণের হাতছাড়া করা হয়েছে।
কুৎসিত  ও বীভৎস অপকর্মসমূহের বিরুদ্ধে মানবতাকে রক্ষা করার জন্যই তো রাষ্ট্র। যারা রাষ্ট্রের আইনকে অবজ্ঞা করে, তারাই থোরাই কেয়ার করার মনোভাব প্রদর্শন করে। ক্ষমতাবানরা প্রতিনিয়ত হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছে, আইনকে অস্বীকার ও অমান্য করে আসছে। যারা সরকারের স্বার্থরক্ষায় তৎপর তারা সরকারের অলিক রীতি-নীতির আওতায় অবিরত আইনবহির্ভূক্ত কর্মকাণ্ড করতে পারবে, নিরীহ জনগণকে দাপট দেখাতে পারবে। এই ক্ষমতাধর শক্তিই বলপ্রয়োগ করে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা অভিপ্রায় নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে নাগরিক অধিকার হরণ করতে এরা কোনো কিছুর পরোয়া করে না। এদের কাছে সংবিধান দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যায়, নীতি-নৈতিকতা ফিকে হয়ে যায়, গণতন্ত্র হয়ে পড়ে ভীতির মুখোমুখি। অপকর্মের নজির স্থাপনকারীরাই গলাবাজির কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করে সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এই প্রভাব অপরিবর্তিত থাকবে।

ক্ষমতাবানরা আইনের বিরুদ্ধে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালাবে, ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, ন্যায্যতার বিকৃতি করবে এবং তাদের অপকর্মের তথ্যপ্রমাণও থাকবে কিন্তু সরকার রহস্যময় নীরবতা পালন করবে, না দেখার ভান করবে, তাদেরকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখবে আর কারও অপকর্ম প্রকাশ হয়ে গণনিন্দা শুরু হলে লোক দেখানো নাটক করবে- এটাকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। সরকার নিজেই যদি শক্তি এবং আইনের অপব্যবহারের অনুমতি দেয়, তাহলে রাষ্ট্র জনগণের অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনবে।

আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বিকৃতভাবে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে ফেলেছি। প্রবঞ্চনার মুখোশে রাষ্ট্রকে ঢেকে ফেলেছি। ক্ষমতা সংহত করতে গিয়ে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকিতে ফেলেছি। আমরা শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করছি নৈতিকতার মানদণ্ড দিয়ে নয়, মতবাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে। বুদ্ধিভিত্তিক জগৎ এবং নৈতিক উৎকর্ষতাকে সমাজ-রাষ্ট্র থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছি। ফলে রাষ্ট্রে সামাজিক সংঘাত এবং চরম রাজনৈতিক নৈরাজ্যের উদ্ভব ঘটেছে। এর মূল কারণ চিহ্নিত না করে-  গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত না করে, নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে নিষ্ঠুর ও নির্মম ভাবে দমন করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নামে রাষ্ট্রকে আমরা ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বা ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। সমাজ থেকে ন্যায়-অন্যায়, উত্তম-অধম, সম্মান-অসম্মান, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য মুছে ফেলেছি। 

সরকার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে যেকোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড বা কলঙ্ককে সম্মান হিসেবে ব্যাখ্যা করে আত্মগৌরব অনুভব করে। নির্বাচনে কারচুপি, যে কাউকে গ্রেপ্তার, কারও ওপর হামলা, কাউকে বিব্রত করা ইত্যাদি অগ্রহণযোগ্য কাজেও স্বপক্ষে যুক্তিখণ্ডন করে আনন্দবোধ করে। সংবিধান লঙ্ঘন করে বিরোধী মত-পথকে স্তব্ধ করতে গিয়ে সারা দেশকে বন্দিশালা করার নকশা করা হয়েছে। যারা  প্রজাতন্ত্রকে দুর্বৃত্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন করার পরিকল্পনাকারী, রাষ্ট্র তাদেরকেই পুরস্কৃত করছে, সম্মানের মুকুট মাথায় পরিয়ে দিচ্ছে।

রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে আক্রমণাত্মক ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। মাফিয়া রাষ্ট্র হিসেবে খেতাবপ্রাপ্ত হচ্ছে। ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপজ্জনক হুমকিতে পড়েছে। ন্যায়, সাম্য ও আইনের বিষয়টিকে যথার্থ প্রয়োগ করার মহত্তম এবং সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে, গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করাকে কর্তব্য মনে করলেই রাষ্ট্র হবে জনগণের।শহীদুল্লাহ ফরায়জীর লেখাটি মানবজমিন থেকে হুবুহু তুলে ধরা হলো।

লেখক: গীতিকবি ও কলামিস্ট