চালের বাজারে বড় শিল্পগ্রুপের নামমাত্র হিস্যা
অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে বড় গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে। খাদ্যমন্ত্রীও তাতে সায় দিয়ে সত্যতা যাচাইয়ে ডেকে বৈঠক করেছেন।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে বড় শিল্পগ্রুপগুলোর লাগাম টানার কথা বলছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে বড় গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে। খাদ্যমন্ত্রীও তাতে সায় দিয়ে সত্যতা যাচাইয়ে ডেকে বৈঠক করেছেন। অথচ উৎপাদন সক্ষমতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের বাজারে বিক্রিত চালের মধ্যে বড় শিল্পগ্রুপগুলোর হিস্যা এক শতাংশেরও কম। এই নামমাত্র অংশ নিয়ে কোনোভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে দাবি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর।
জানা যায়, দেশে এখন চালের উৎপাদন প্রায় চার কোটি টন। এর মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ চাল বাজারে বিক্রি হয়, বাকিটা উৎপাদক নিজে ভোগ করেন। এমনটাই বলছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষণা। অর্থাৎ, এ হিসাবে বছরে বাজারে বিক্রি হয় প্রায় আড়াই কোটি টন চাল।
কিন্তু বড় শিল্পগ্রুপের মিলগুলোর বার্ষিক উৎপাদনের তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, দেশের চাল বিপণনকারী বড় ছয়টি প্রতিষ্ঠান মিলে সর্বোচ্চ চাল উৎপাদন সক্ষমতা (মিলিং ক্যাপাসিটি) মাত্র তিন লাখ ১৪ হাজার টন। যেখানে প্রকৃত উৎপাদন বছরে দুই লাখেরও কম। এর মধ্যে আবার সুগন্ধি ও অন্য চালের প্রকার বাদ দিলে শুধু সাধারণ ভাতের চালের পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় লাখের কাছাকাছি। সার্বিক বাজারের তুলনায় শিল্পগ্রুপগুলোর হিস্যা একেবারেই নামমাত্র।
তথ্য বলছে, দেশে এখন চালের বাজারে সবচেয়ে বড় হিস্যা মেঘনা গ্রুপের। এ প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক চাল উৎপাদন সক্ষমতা কমবেশি এক লাখ ২০ হাজার টন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ চাল সিদ্ধ চাল ও বাকিটা আতপ চাল প্রক্রিয়াকরণ করে প্রতিষ্ঠানটি।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সিটি গ্রুপের সক্ষমতা বছরে প্রায় ৭৮ হাজার টন। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ সিদ্ধ ও হাইব্রিড এবং বাকি ১০ শতাংশ সুগন্ধি চাল। এর পরের অবস্থানে এসিআই ৪০ হাজার টন, স্কয়ার ৩০ হাজার টন, প্রাণ ২৮ হাজার টন ও আকিজ ১৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে। এর মধ্যে আবার প্রায় ৬০ শতাংশ ভাতের চাল ও বাকিটা সুগন্ধি।
আমাদের এত কম ক্যাপাসিটি, তারপরেও কেন যে না বুঝে আমাদের দোষারোপ করা হচ্ছে! আসলে একটি পক্ষ নিজেদের দোষ লুকানোর জন্য অন্যদের দিকে আঙুল তুলছে।-সিটি গ্রুপের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) আমিন সিদ্দিকী
বাজারে এত কম অংশীদার হওয়ার পরও বিভিন্ন সময় বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলোকে চালের দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভোটের পরে হঠাৎ বাড়তে শুরু করা চালের দামের প্রসঙ্গ নিয়ে চাল ব্যবসায়ীরা খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে এ অভিযোগ করছেন। গত বুধবার খাদ্য অধিদপ্তরে এক বৈঠকে বড় বড় চালকল মালিকসহ মাঝারি ও ছোট চালকল মালিক এবং খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের ডাকা হয়। তখন তারা অভিযোগ করেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠান বেশি দামে ধান-চাল কিনে বাজার বাড়িয়েছে। একই ধরনের অভিযোগ তারা বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীকেও করেছেন মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ব্যবসায়ীদের এক বৈঠকে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বড় বড় ছয়টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়ে সোমবার (২২ জানুয়ারি) দুপুরে বাংলাদেশ সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সভা করেছেন খাদ্যমন্ত্রী। এসময় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে তাদের অবস্থান তুলে ধরে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্যাপাসিটি ও ক্রয়-বিক্রয়ের চিত্রও জানায়।
করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা এসময় দাবি করেন, এত কম হিস্যা নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ কখনো সম্ভব নয়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডভ্যালু নষ্ট করার জন্য চাল ব্যবসায়ী ও ছোট মিলমালিকরা এমন অভিযোগ করছেন।
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) আমিন সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের এত কম ক্যাপাসিটি, তারপরেও কেন যে না বুঝে আমাদের দোষারোপ করা হচ্ছে! আসলে একটি পক্ষ নিজেদের দোষ লুকানোর জন্য অন্যদের দিকে আঙুল তুলছে। তিনি বলেন, ‘বড় বড় প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত দামে চাল কিনছে এ অভিযোগও ভিত্তিহীন। কারণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা চাইলেই বেশি দামে কিনতে পারেন না। সবচেয়ে কম দামে চাল কেনার প্রতিযোগিতা রয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। বিক্রির ক্ষেত্রেও কম মুনাফা করে দ্রুত বিক্রির চাপ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই থাকে।’
আমিন সিদ্দিকী বলেন, ‘বরং যিনি নিজে মিলমালিক, নিজেই প্রতিষ্ঠানের সব করেন এমন ছোট ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দামে কিনতে পারেন। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এছাড়া আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মজুত ক্রয়-বিক্রয়ের নিয়মিত তথ্য দিতে হয়। সেজন্য আমাদের গোপন করার কিছু নেই।’ কেন দাম বেড়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্টক ব্যবসার নামে নিবন্ধনবিহীন এক শ্রেণির মজুতদার যারা চাল কিনে মজুত করেছেন, তারাই এ বাজার অস্থিতিশীল করেছেন।’
স্কয়ারের চিফ অপারেটিং অফিসার পারভেজ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যে চাল বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করছে সেগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ আবার সুগন্ধি চাল। ভাতের চালের বাজারে কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠানের তেমন প্রতিনিধিত্ব নেই। তিনি বলেন, ‘তারপরেও চালের দাম স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে সবার দায়িত্ব রয়েছে। সে জায়গা থেকে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে চাল কেনা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হচ্ছে। সে বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করছি, যেন সার্বিক বাজার কিছুটা কমে আসে।’
পারভেজ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘করপোরেটদের যে উৎপাদন সক্ষমতা সেটাও কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করতে পারে না। অর্থাৎ কারও পাক্ষিক সক্ষমতা ১০০ টন হলে তার উৎপাদন কিন্তু পুরোটা হয় না। আর সে কিন্তু তিনগুণের বেশি মজুতও রাখতে পারে না। এসব হিসাবে নিলে দেখা যায়, এত বড় বাজারে মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবে সম্ভব নয়। যে চাল বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করছে সেগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ আবার সুগন্ধি চাল। ভাতের চালের বাজারে কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠানের তেমন প্রতিনিধিত্ব নেই।- স্কয়ারের চিফ অপারেটিং অফিসার পারভেজ সাইফুল ইসলাম
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘ভোটের পরে কিন্তু বাজারে খুচরা ও পাইকারি চালের দাম ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সেখানে প্রাণের চালের দাম গত চারমাসে এক টাকাও বাড়েনি। এদিকে বড় প্রতিষ্ঠানকে সোমবারের বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, যেহেতু চালের দাম বাড়ছে তাই এখন বাজারে প্রতিযোগিতা করে ধান কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্যাপাসিটির বেশি অবৈধ মজুত করা যাবে না। এছাড়া এখন থেকে বস্তার গায়ে চালের মিলগেটের মূল্য উল্লেখ করতে হবে।
তিনি বলেন, এর আগে মিলারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম। তারা বলেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতা করে ধান কিনে মজুত করছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান মোটা চালের ব্যবসা না করলে আমাদের সঙ্গে বসার প্রয়োজন ছিল না। মিলাররা আপনাদের দিকে আঙুল তোলে। মিডিয়াও দোষারোপ করে। আমরা প্রকৃত চিত্র জানতে চাই।
এদিকে তথ্য বলছে, দেশে ধান–চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার হাত বদল হয়। প্রতিবার হাত বদলের সময় যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। দেশে উৎপাদিত চালের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ চাল বাজারে বিক্রি হয়। এর মধ্যে বোরো মৌসুমের সর্বোচ্চ ৬৬ দশমিক ২ শতাংশ চাল বিক্রি হয় বাজারে। ব্রির এক গবেষণায় দেখা যায়, বাজারে ধান–চালের ব্যবসায় মূলত পাঁচটি পক্ষ জড়িত। প্রথমত কৃষক নিজে, দ্বিতীয়ত ফড়িয়া, তৃতীয়ত আড়তদার, চতুর্থত চালকলমালিক ও পঞ্চমত চালের খুচরা বিক্রেতারা।
বাংলাদেশের প্রধান এ খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ছে। ফলে আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে না। ডলার-সংকটসহ নানা অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশ চালের দামের পরিস্থিতি ভোটের আগে পর্যন্ত কিছুটা হলেও স্বস্তিতে ছিল। ভোটের পরে হুট করে চালের অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। এটা অস্বস্তিতে ফেলেছে নতুন সরকারকে। পাশাপাশি খরচের চাপ বেড়েছে সব শ্রেণির মানুষের।