প্রথম নিউজ, ঢাকা: উত্তরাধিকারের ধারার রাজনীতিতে ঢাকার কাছের এক শহরের গল্প। ধ্রুপদী ধারার এক রাজনীতিবিদ সেই শহরের জনপ্রিয় পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর নাম আলী আহাম্মদ চুনকা। শহরের নাম নারায়ণগঞ্জ। চুনকা সাহেবের এন্তেকালের পর তার কন্যা ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী বাবার রেখে যাওয়া ঝাণ্ডা হাতে নেন। সাধারণ চলন-বলন ও সাদামাটা বেশভূষার এ আটপৌরে কন্যাটি বাবার দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব ও পৌরসভার কর্তৃত্ব অচিরেই কব্জা করতে সক্ষম হন। তবে শহরের প্রভাবশালী আরেক রাজনৈতিক পরিবারের ওসমান ব্রাদার্সরা অচিরেই আইভীর অগ্রযাত্রার পথে চ্যালেঞ্জার হয়ে দাঁড়ান। ওসমান পরিবারের কনিষ্ঠ ভাইটি আওয়ামী লীগের দোর্দন্ডপ্রতাপশালী ক্যাডার নেতা। পারিবারিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি অনেকটা সন্ত্রাসী ইমেজ নিয়ে আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন তিনি। পৌরসভায় আইভী আর সংসদে শামীম ওসমান - আপোসের এই বাটোয়ারায় আওয়ামী লীগ তাদেরকে অনেক দিন চালালেও পৌরসভা যখন সিটি কর্পোরেশন হলো, তখন ওসমানেরা আর আইভীকে ছাড় দিতে রাজি হন না। তারা ধরেই নেন যে, এভাবে আইভীর প্রভাব বাড়তে দিলে শহরের ও জেলার নেতৃত্ব পুরোই চলে যাবে তার কব্জায়। ২০১১ সালে প্রথম সিটি কর্পোরেশনের ইলেকশন হয় নারায়ণগঞ্জে। সে নির্বাচনে আইভীকে হটিয়ে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নমিনেশন বাগিয়ে নেন শামীম ওসমান। বিএনপি নমিনেশন দেয় তৈমুর আলম খন্দকারকে। তৈমুর ও ওসমান পরিবারের মধ্যে বরাবরই একটা সখ্য রয়েছে। ওদিকে আওয়ামী লীগের নমিনেশন-বঞ্চিত ক্ষুব্ধ আইভী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে যান। নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এ সময় আইভী একটি সূত্র মারফত বিএনপির কাছে বার্তা পাঠান যে, এভাবে ত্রিমুখী লড়াই হলে তৈমুর-আইভীর ভোট কাটাকাটিতে শামীমের জিতে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
শামীমের ব্যাপারে বিএনপির, বিশেষ করে চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার তীব্র আপত্তি ছিল। আওয়ামী শাসনামলে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামমুখী লংমার্চের কাফেলাকে কাঁচপুরে গতিরোধ করে অনেক অনর্থ কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। শামীম ওসমান ও তার অনুগত বাহিনী সেই সন্ত্রাসী অপকাণ্ডের পুরোভাগে ছিল। নারায়ণগঞ্জে খালেদা জিয়াকে কোনও সভা করতে না দেয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন এই শামীম। এসব কারণে বিএনপির কাছে নারায়ণগঞ্জে জেতার চাইতে হাসিনা মনোনীত আওয়ামী প্রার্থী শামীমকে হারানোই সে সময় বড় হয়ে ওঠে। তাছাড়া আইভীর হয়ে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করা সূত্রটি তখন এমন আভাসও দেয় যে, মেয়র হতে পারলে বিএনপিতে যোগ দিতে ইচ্ছুক আইভী। বিএনপি তৈমুর আলম খন্দকারকে নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় এবং আইভীকে সমর্থন করে। ভোটে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী শামীম ওসমানকে হারিয়ে আইভী বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র হয়েই আইভী চোখ ওল্টান। পুরোই আওয়ামী চরিত্রে আবির্ভূত হন। বেগম জিয়াকে নারায়নগঞ্জে জনসভা করার মাঠ বরাদ্দ দিতেও অস্বীকার করেন। এভাবে তিনি আবারও অর্জন করেন শেখ হাসিনার আস্থা। তবে জনতার আস্থা হারাতে থাকেন। এ কারণে পরের নির্বাচনে তাকে জিততে হয় বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াতকে প্রশাসন ও পুলিসের মাধ্যমে কারসাজি করে হারিয়ে।
এবার বিএনপি ইলেকশনে নেই। ফলে বিএনপি সমর্থকরা ভোট দিতে যেতে কতটা আগ্রহী হবেন তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে বিএনপির তৈমুর আলম খন্দকার দলের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন আইভীর বিরুদ্ধে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওসমান ব্রাদার্সের সাপোর্ট তৈমুর পাবেন। যদি তৈমুর ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে পারেন, তা'হলে আইভির জেতা ভারি কঠিন এবারে। জিততে হলে এবার নারায়ণগঞ্জে গতবারের চেয়েও অনেক বেশি ও ব্যাপক কারসাজি করতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে।
মারুফ কামাল খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ; সাবেক প্রেস সচিব, বিএনপি চেয়ারপারসন
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: