হামাক তিস্তার ভাঙন থাকি বাঁচান: মরিয়ম বেগমের আকুতি
শুধু মরিয়ম না তার মতো আরও অনেকে এখন নদী ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এরই মধ্যে ২৫টি বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। পরিবারগুলো বাঁধের রাস্তায় ও অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রথম নিউজ, লালমনিরহাট: ‘হামাক তিস্তার ভাঙন থাকি বাঁচান। ঘরদুয়ার নদীতে চলি গেইছে। এই নদী হামাক শ্যাষ করি দিছে। এখন রিলিফ-স্লিপ কিছুই চাই না। নদীর বাঁধ চাই। হামার ঘরদুয়ার ভাসি গেইছে। আর কারো ঘর যেন ভাসি না যায়। এভাবেই কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের বাগডোরা গ্রামের মরিয়ম নেছা (৫০)। শুধু মরিয়ম না তার মতো আরও অনেকে এখন নদী ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এরই মধ্যে ২৫টি বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। পরিবারগুলো বাঁধের রাস্তায় ও অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে।
কয়েক দফা বন্যার পর তিস্তার পানি নেমে যাওয়ায় লালমনিরহাটের বেশ কিছু এলাকায় দেখা দিয়েছে এই ভাঙন। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষ। হুমকির মুখে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর, খুনিয়াগাছ বাগডোরা, আদিতমারী উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি ও হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না গড্ডিমারি এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। এছাড়া তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকার কমপক্ষে ২০টি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এসব জায়গায় বসতভিটা, ফসলি জমি, গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বাগডোরা গ্রামের বাসিন্দা জহুরুল হক বলেন, ভিটাবাড়ি আর বাবা-মায়ের কবর তিস্তা গিলে খেয়েছে। এবারসহ চারবার বাড়ি ভেঙে গেল। অন্যের জমিতে বাড়ি করে থাকি। কিছু টাকা জোগাড় করে একটা জমি কিনে বাড়ি করছি। সেই বাড়িও নদীতে ভেঙে গেল। এখন থাকার জায়গা নেই। যাওয়ারও কোনো পথ নেই।
একই এলাকার গফুর মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাঙতে ভাঙতে মোর বাড়িটাও ভাঙিয়ে গেল। তিনদিন ধরে ঘুম নাই, খাওয়া নাই। পরিবার নিয়ে কই যামু কোনো দিশা পাই না।’ শফিকুল ইসলাম বলেন, রোজগারের জন্য ঢাকায় ছিলাম। বাড়ির লোকজন ফোনে জানালো জমি-বাড়ি ও গাছপালা সব নদী ভাঙনে। তাই ছুটে এলাম। এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা চন্ডিমারীর বাসিন্দা খয়বর হোসেন বলেন, তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় আবার নদী ভাঙন আতঙ্কে রয়েছি। সরকার থেকে জিও ব্যাগ ফেললেও কাজে আসছে না।
খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান মণ্ডল বাদল বলেন, উজান থেকে পানির সঙ্গে বালু এসে মূল নদী বন্ধ হয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফলে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ভাঙনকবলিত অনেক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম আরিফ বলেন, গত বছর ইউনিয়নের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ভাঙন দেখা দিলে গৃহহীন হয়ে পড়েন অনেকে। এ বছরের ভাঙনের তীব্রতা কম হলেও হুমকির মুখে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক ও চর সিন্দুর্না সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়। ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাট জেলার সভাপতি শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে আমরা সভা-সমাবেশ করছি। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ এলাকার দুঃখ-দুর্দশা, নদী ভাঙন আর থাকবে না। নদী ভাঙন ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে দ্রুতই স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তার।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, দ্বিতীয় দফায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর এখন কমতে শুরু করছে। এতে করে লালমনিরহাট সদর উপজেলা ও আদিতমারী উপজেলার কয়েকটি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ভাঙন। তবে ভাঙন ঠেকাতে আপদকালীন কাজ হিসেবে বিভিন্ন পয়েন্টে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।