সুশাসন ফেরাতে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিক্ষোভ

সুশাসন ফেরাতে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিক্ষোভ

প্রথম নিউজ, অনলাইন: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পরই পাল্টাতে শুরু করেছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের চিত্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক খাতে আর্থিক দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও দখলদারদের বিতাড়িত করতে ও নিয়ন্ত্রণ নিতে বিক্ষোভ করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এতে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। আবার মালিকানা বদলেরও গুঞ্জন উঠেছে। এদিকে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং পরিচালকরা পালিয়ে রয়েছেন। এ ছাড়া বেশির ভাগ ব্যাংক ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইডিআরএ) অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠান এখন অভিভাবকশূন্য। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, দখলদার আর ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে পুরো আর্থিক খাতে ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিতাড়িত করে দ্রুত বিচারের দাবি জানান ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়ায় সংস্থাগুলোর প্রধানরা নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় আছেন বলে জানা গেছে। 

সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর প্রথম কার্যদিবসে প্রথমে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকে বিক্ষোভের শুরু হয়। এরপর ৭ই আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার ৮ই আগস্ট বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সবমিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাত এক অস্থিরতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।

গত ৬ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম কর্মদিবসে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের পর পদায়ন পাওয়া এক্সিকিউটিভসহ (নির্বাহী কর্মকর্তারা) যারা অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এসব নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম গ্রুপের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত বলে দাবি ইসলামী ব্যাংকের সিবিএ নেতাদের। পরে বুধবার এস আলম গ্রুপের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে এলে তাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবার রাজধানীর দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েকজনকে মারধর করে বের করে দিতে দেখা গেছে। এর আগে ব্যাংকের আরেক ডিএমডি রেজাউর রহমানকে মারধর করেছেন ব্যাংকটির লোকজন। এ ছাড়া এস আলমের ‘বিশেষ কৃপায়’ পদোন্নতি পাওয়া আরও অন্তত চার-পাঁচজনকে মারধর করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।

এদিকে ৭ই আগস্ট নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ওইদিন বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর। তারা হলেন- কাজী সাইদুর রহমান, খুরশীদ আলম, হাবিবুর রহমান এবং নুরুন নাহার। এরমধ্যে কাজী সাইদুর রহমান ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সাদা কাগজে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। অন্যরা পদত্যাগ করবেন জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ত্যাগ করেন। আর বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এবং নীতি উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাসেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে না দেয়ার ঘোষণা দেন বিক্ষোভকারী কর্মকর্তারা।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খোঁজ মিলছে না গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে আসছেন না। অনেকে বলছেন দেশ থেকে পালাতে তিনি অনেক মহলে দেনদরবার করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের পক্ষ থেকে মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশসহ সব আইন সংশোধন করতে বলেছেন। 

কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক খাতের ভঙ্গুরতার কারণে দেশে অর্থনীতির আজকের এই খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কষ্টে আছে। তাই গভর্নরসহ বিভিন্ন অনিয়মে দায়ী কর্মকর্তা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিচার করতে হবে। এ ছাড়া যেসব নির্বাহী পরিচালক অনিয়মে সহায়তা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
এদিকে গত ৮ই আগস্ট গুলশানে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। ওই সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।

ইউসিবি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম। তারা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত উভয়ের পরিবারের সদস্যরাই ব্যাংকটিতে যুক্ত ছিলেন ও নেতৃত্ব দেন।

ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের মালিক পরিবারের সদস্যদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান। তবে রুকমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন, এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

২০১৭ সালে শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এসআইবিএলের মালিকানা নেয় এস আলম গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে সব পরিচালককে তুলে নিয়ে এই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ৮ই আগস্ট ওই সময়কার চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. রেজাউল হক, তখনকার অন্যতম পরিচালক আনিসুল হকসহ কয়েকজন পরিচালক ব্যাংকে যান। তারা ব্যাংকে গিয়ে বোর্ডরুম ও চেয়ারম্যানের জন্য নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে বসে পড়েন। এ সময় অনেক কর্মকর্তা সেখানে জড়ো হয়ে ব্যাংকটি এস আলমমুক্ত করার দাবি তোলেন। উপস্থিত সবার চাপে পদত্যাগে বাধ্য হন এস আলম গ্রুপের আস্থাভাজন ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুল হান্নান খান ও মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। অবশ্য পরিচালনা পর্ষদের সবাই পলাতক থাকায় তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ হবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের পুনর্বহালের দাবিতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ্‌? ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের একটি গ্রুপ এবং সিটি ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বিক্ষোভ করেছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ওয়ান ব্যাংকে। এ ছাড়া বুধবার রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।
ওদিকে দেশের রাজস্ব আদায়ের প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তার পদত্যাগের দাবিতে বুধবার দিনভর বিক্ষোভ করেছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। অফিস করছেন না বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।

বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাবেক জয়নুল বারী। কিন্তু তিনিও অফিস করছেন না। এ ব্যাপারে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাড়া দেননি। ফলে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শীর্ষ কর্তা না আসায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংস্থার প্রধানরা অফিসে না আসায় কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছুটি ছাড়া নিজের ইচ্ছায় অফিসে না আসা শৃঙ্খলা ভঙ্গ। আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। এখন সময় হলো ব্যাংক খাতকে টেনে তোলার। আতঙ্কিত গ্রাহক আমানতের টাকা তুলে নিতে শুরু করলে দেশের অনেক ব্যাংকই দেউলিয়া হয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করছেন, এখন মারামারির সময় নয়। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতো অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে স্থান পেয়েছেন। তার প্রথম দায়িত্ব হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অচলাবস্থা দূর করা। দ্রুত ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল করে আনা।