ছাড় হয়নি প্রতিশ্রুতির ৪৫ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় অংশীদার

কঠিন শর্ত বাস্তবায়ন করতে না পারায় বিশ্বব্যাংকের ঋণের ৪৫ শতাংশ অর্থই ছাড় করাতে পারছে না বাংলাদেশ

ছাড় হয়নি প্রতিশ্রুতির ৪৫ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় অংশীদার

প্রথম নিউজ, ঢাকা : কঠিন শর্ত বাস্তবায়ন করতে না পারায় বিশ্বব্যাংকের ঋণের ৪৫ শতাংশ অর্থই ছাড় করাতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে পাইপলাইনে আটকে রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। বিশ্বব্যাংক গত ৫০ বছরে বাংলাদেশকে কম সুদে ৪ হাজার কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে ওই সময়ে ছাড় হয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার। যা মোট প্রতিশ্রুতির ৫৫ শতাংশ।

বাকি ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। যা মোট প্রতিশ্রুতির ৪৫ শতাংশ। এসব অর্থ এখনো ছাড় হয়নি। এসব ঋণের বিপরীতে বিশ্বব্যাংকের শর্ত বাস্তবায়ন করতে না পারা, প্রকল্প অনুমোদনসহ আনুষঙ্গিক কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়ার কারণে ছাড় হয়নি।

সূত্র জানায়, গত জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। যা মোট বৈদেশিক ঋণের ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। দেশের মোট জিডিপির আকারের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।

এদিকে চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক থেকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ ছাড়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাজেট সহায়তা বাবদ ৫০ কোটি ডলার আটকে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে এসব অর্থ ছাড় হতে পারে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছে।

এদিকে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫০ কোটি ডলার, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ কোটি ডলার এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আরও ৫০ কোটি ডলার করে ছাড় হতে পারে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। এখন তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। এ কারণে আগামীতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড় আরও বেশি হতে পারে।

গত জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট ঋণ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৭ হাজার ২২৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অভ্যন্তরীণ ঋণ ৯ হাজার ৩৮৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যা মোট ঋণের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং জিডিপির ২২ দশমিক ১ শতাংশ।

এদিকে আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামীতে দেশের জিপিপির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণের পরিমাণও বাড়বে। জিডিপির হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ ছিল ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হবে ৪২ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হবে ৪২ দশমিক ৪, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হবে ৪২ দশমিক ৮, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে হবে ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক। তবে অনেক ঋণের বিপরীতে কঠিন শর্ত আরোপ করা হয়। এসব শর্ত বাস্তবায়ন করতে না পারায় ঋণের অর্থ ছাড় করানো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে না পারা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা কারণেও ঋণ ছাড় বাধাগ্রস্ত হয়।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যেমন স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় চার হাজার কোটি ডলার সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদান দিয়েছে। মূলত তিনভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে সংস্থাটি।

এগুলো হলো-বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়। এছাড়া পরামর্শক সেবা দিয়ে থাকে। যেমন উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে অনেক সময় পলিসি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়। এর বাইরে কারিগরি সহায়তা হিসাবেও সহায়তা দেয় বিশ্বব্যাংক। যেমন দারিদ্র্য নিয়ে জরিপ করা, এর প্রশ্নপত্র তৈরি, কম্পিউটারসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ইত্যাদি দিয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অনুদানও দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়নে অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যমুনা সেতু এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম দুই লেন প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেই সঙ্গে গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন, শিক্ষা বিশেষ করে প্রাথমিক স্কুল তৈরি, শিক্ষক নিয়োগ, উপবৃত্তি দেওয়া এবং বই প্রকাশনাসহ নানা ক্ষেত্রে সহায়তা দিচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এটি প্রায় ১৫ বছর ধরে চলছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও নগদ টাকা এবং সিস্টেম উন্নয়নে সহায়তা দিয়েছে সংস্থাটি। এভাবে অবকাঠামো, সামাজিক, বাণিজ্যিক এবং যোগাযোগ উন্নয়নসহ অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বব্যাংক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রেই যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ কাক্সিক্ষত ফল দিয়েছে তা নয়। যেমন পদ্মা সেতুতে প্রতিশ্রুতি দিয়েও ঋণ দিতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় অর্থ ছাড়ও ঠিকমতো হয়নি। এসব ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, দরপত্র প্রক্রিয়া দ্রুত করা, দ্রুত প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আগেভাগেই করতে হবে।

সূত্র জানায়, ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য পদ লাভ করে। তখন থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলার। এর বিপরীতে পেয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার। আটকে আছে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের নভেম্বরে প্রথম বাংলাদেশকে ৫ কোটি ডলারের ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক। যে অর্থ দিয়ে জ্বালানি খাতের উন্নয়ন করা হয়। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পরিবহণ ও যোগাযোগ, কৃষি এবং শিল্প উন্নয়নেও খরচ করা হয়েছে। বর্তমানের বিশ্বব্যাংকের অর্থে ৫৬টি প্রকল্প চলমান রয়েছে।