প্রথম নিউজ, ডেস্ক: কেউ এখানে চিরকাল থাকেনা, থাকতে পারে না। চলে যেতে হয়। প্রত্যেককেই বিদায় নিতে হয় এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। গাজী ভাইও চলে গেলেন। খুব আচমকা। ভাবনার বাইরে। বয়স হলেও তিনি কর্মিষ্ঠ ছিলেন। সচল, সতেজ ও সক্রিয় ছিলেন। ছিলেন প্রবল সৃজনশীল ও তৎপর। রোগ-বালাইতেও তেমন কাবু ছিলেন-না। সেই তিনিই এমন করে চলে যাবেন, ভাবা যায়না। চিন্তা করতেও কষ্ট হয়। তবু বাস্তবে তা' ঘটে গেলে কঠিন হয়ে ওঠে মেনে নেয়া। দুর্বহ হয়ে ওঠে বেদনা। এই বন্ধ্যাকালে তাঁর মতন একজন সপুষ্পক সৃজনশীল মানুষের মৃত্যু সত্যিই এক অপুরণীয় ক্ষতি। গানের জন্য এমন করে কথার ফুল ফোটাবার মতন গীতিময় মানুষ আর সহজে ও সহসা কি মিলবে? তাঁর গানের বিষয়বস্তু ছিল বর্ণাঢ্য। প্রকৃতি, নিসর্গ, প্রেম থেকে শুরু করে স্বদেশবন্দনা ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহ্বান সম্বলিত। তাঁর লেখা অগণিত গান বিপুল ভাবে জননন্দিত হয়েছে। গণসঙ্গীত ও দেশের গানের মাধ্যমে তিনি আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধেও রেখেছেন প্রেরণা-সঞ্চারী অবদান। তাঁকে দেয়া পদক, পুরস্কার ও স্বীকৃতিগুলোই তাই ধন্য হয়েছে বলে আমি মনে করি। গাজী ভাই মানে গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এ নাম উচ্চারণেই মানসপটে ভেসে ওঠে যাঁর অবয়ব এবং যাঁর কৃতি জীবনচিত্র হয়ে ওঠে বাঙময়, তাঁর পরিচয় তুলে ধরতে বাঙলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে বেশি বাক্যব্যয়ের দরকার পড়ে না। অনন্য এ গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর সৃজনকর্মের কারণেই এই দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ সময়েও এদেশে রাজনৈতিক বিভেদের দু'পাশেই সম্মানের আসন পেয়েছেন। আবার এ নিয়ে আড়ালে আবডালে কিঞ্চিৎ সমালোচনাও ছিল। তবে এটাকে তাঁর সৃজনশক্তির কৃতিত্ব ও সর্বজনগ্রাহ্যতা হিসেবেও দেখা যায়। খুব দুঃসময়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির সাংস্কৃতিক ধারার নেতৃত্বের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এ সময়ে অনেকে নিজের অতীত ও বিশ্বাস লুকিয়ে ক্ষমতাসীনদের নেকনজর পাবার ভিখারি সেজেছেন। তাদের তুলনায় গাজী ভাইয়ের সে সুযোগ বেশি থাকলেও তিনি ক্ষমতার বৈরী শিবিরকেই বেছে নিয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। গাজী ভাই আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। অনেক সময় কিছু ক্ষেত্রে আমরা একত্রে কাজ করেছি। বিশেষ করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডে পরপর দুই মেয়াদে আমিও তাঁর সঙ্গে সদস্য ছিলাম। সেখানে মোফাজ্জল করিম, সাদেক খান, সুভাস দত্ত, ববিতা এবং চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আরো সব নামজাদা ব্যক্তিত্ব ও বোদ্ধারা তাঁকে কতোটা সম্মান করতেন ও মর্যাদা দিতেন এবং তাঁর মতামতকে কতোটা গুরুত্ব দিতেন আমি তা খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
আমি নিজেও অসুস্থ। বড়সড় সার্জারির পরেও এখনও সুস্থতা নিশ্চিত হয়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই মন ভারাক্রান্ত থাকে। এর মধ্যে সকালে উঠেই গাজী ভাইয়ের আকষ্মিক মৃত্যুসংবাদ এলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন। আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ফের আঘাত পাবার মতনই এ বেদনাভার সত্যিই দুঃসহ। কোনও মানুষই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত ও নিষ্কলুষ নয়, হতে পারে না। গাজী ভাইয়েরও নিশ্চয়ই ভুল-ত্রুটি হয়েছে। কায়মনোবাক্যে আমি প্রার্থনা করি, তাঁর সব ত্রুটি-বিচ্যুতি-ভ্রান্তি মার্জনা করে পরম ক্ষমাশীল আল্লাহ্ যেন তাঁর বিদেহী রুহের পারলৌকিক মুক্তি ও কল্যাণ দান করেন।
লেখক: মারুফ কামাল খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ; সাবেক প্রেস সচিব, বিএনপি চেয়ারপারসন (ফেইসবুক ওয়াল থেকে)