ঢাকায় চিন্তায় ছিনতাই: পুলিশও অসহায়! মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রথম নিউজ, অনলাইন: গা শিউরে ওঠা এক একটা ছিনতাইকাণ্ড রাজধানীতে। কেবল নগরীর ভেতর নয়, ক্ষেত্রবিশেষে প্রবেশমুখগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীর প্রবেশপথগুলোসহ মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মিরপুর, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, খিলগাঁওয়ের কয়েকটি এলাকা ছিনতাইর হটস্পটে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যা, রাত ভোর নয়, দিনদুপুরেরও মানুষকে অস্ত্র ঠেকিয়ে যা পাচ্ছে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অকার্যকারিতা ছিনতাইকারীদের জন্য আশীর্বাদের মতো। ওসি, এসআই, এএসআই বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন থানায় কর্মরতদের বেশিরভাগই রাজধানীতে নতুন। দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার অলিগলিও ঠিকভাবে চেনেন না। এলাকাভিত্তিক অপরাধীদের আপডেট তথ্য নেই তাদের কাছে। তাই কখনো নির্লিপ্ত থাকছেন। কখনো তৎপর হলেও অপরাধী শনাক্তে কুলাতে পারছেন না।
পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, দোকানদারসহ সব শ্রেণিই ছিনতাইর শিকার হচ্ছে। ৫ আগস্টের ধাক্কার পর রাজধানীতে পুলিশি কার্যক্রম এখনো অগোছালো। ছিনতাইর সব মামলা নিতেও চায় না পুলিশ। এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাত আলীর রাজধানীতে ছিনতাইর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণায় জনমনে কিছুটা আশা উঁকি দেয়। কিন্তু, পুলিশের অ্যাকশন সেই মাত্রায় নয়। এরপরও কমিশনারের ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক ছিনতাইকারীকে আটক করা করেছে পুলিশ। র্যাবও ধরেছে প্রায় সমসংখ্যককে।
পটপরিবর্তনের পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত অপরাধ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশি খারাপ মোহাম্মদপুরের পরিবেশ। দিন-দুপুরে বড় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গোলাগুলি বা রামদা-চাপাতি হাতে প্রকাশ্যে ছোটাছুটি বেড়েছে। কখনো ভোরে, কখনো দিনে-দুপুরে ফাঁকা সড়কে ছিনতাই, কখনো বসে থাকা মানুষদের কোপানো হচ্ছে। ২০ অক্টোবর নবোদয় হাউজিংয়ের বি ব্লকের ৪ এ সড়কে তরুণীকে ঘিরে ধরে ছিনতাইর একটি দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। গেল সাড়ে চার মাসে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় সাতটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে কিছু অপরাধী ধরা পড়লেও পরিস্থিতির উন্নতি নেই।
অপরাধ নির্মূলে তৎপরতা অনেকাংশে বেড়েছে বলে দাবি পুলিশের। পাশাপাশি গোয়েন্দা শাখার সদস্যরাও কাজ করছে। ছিনতাই প্রতিরোধে চেকপোস্ট ও টহল বাড়ানো হয়েছে। ডিএমপির তথ্য বলছে, অক্টোবরে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের মামলাই হয়েছে ২০টি। নভেম্বরে ২৭টি। আর ডিসেম্বের প্রথম ১০ দিনে ৭টি। গত চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ গেছে ৭-৮ জনের।
পুলিশের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়। তাদের তথ্য বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গত আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়ে ছিনতাইর ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি। গত বছর এই চার মাসে মামলা হয়েছিল ৬৭টি। ফলে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ছিনতাইয়ের মামলা দুটি কম হয়েছে। এটি সংখ্যার ফের। বাস্তবে গত বছরের সঙ্গে এ বছরের তুলনা চলে না। এ বছরের আগস্ট মাসে পুলিশি কার্যক্রম একেবারেই ভেঙে পড়েছে। যা এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
ঢাকায় ডাকাতির ঘটনা সাধারণত কম। মামলাও কম। পুলিশের তথ্য বলছে, চলতি বছর আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়ে ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৭টি। গত বছর একই সময়ে মামলা হয়েছিল ৬টি। চুরির ঘটনায় এবার মামলা হয়েছে ৩৪০টি। গত বছর একই সময়ে মামলা হয়েছিল ৫৩৪টি। মামলার সংখ্যা দিয়ে ঘটনা বা বাস্তবতা নিরূপণ করার অবস্থা নেই।
টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়ার চেয়ে পৈশাচিক কায়দায় জখমেও আনন্দ পাচ্ছে কিশোর বয়সী ছিনতাইকারীরা। আর এমনই একটা অবস্থা ছিনতাইয়ের পর ভুক্তভোগীর সাহায্যে এগিয়ে আসে না কেউ। একদিকে, ছিনতাইকারীদের মানসিক বিকৃতি, আরেকদিকে আশপাশের সাধারণ মানুষের নিজের আপন প্রাণ বাঁচানোর এ প্রবণতা অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
চলমান আতঙ্কের সময় অনেক ক্ষেত্রে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ নিয়ে যান না। পুলিশও বলছে, ঢাকায় ছিনতাই বেড়েছে। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, তার কাছে যে রিপোর্ট, তাতে দেখা যায় ছিনতাই অনেক বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ছিনতাই হচ্ছে মুঠোফোন।’ বাসে যাত্রী বসে থাকে, মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে মুঠোফোন ছিনতাই হচ্ছে। এসব ঘটনায় মামলা হয় না। সব ভুক্তভোগী থানায়ও যান না।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার বেশি চ্যালেঞ্জে পড়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। অভ্যুত্থানের পর পুলিশ থানা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় অপরাধ দমন কার্যক্রমে স্থবিরতা নামে। নতুন সরকার আইজিপি-ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের জনবলে ব্যাপক পরিবর্তন আনলেও আইনশৃঙ্খলার কাজে গতি ফেরাতে পারেনি। এর পুরো সুযোগটা নিয়েছে দুষ্টচক্র। ঢাকার রাস্তায় দিনদুপুরে ধারালো অস্ত্র হাতে ছিনতাইয়ের কয়েকটি ঘটনা স্যোশালমিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া মানুষকে আলোড়িত করে। পুলিশের শীর্ষমহলেও নড়াচড়া শুরু হয়। কিন্তু, সেই দৃষ্টে কার্যকর পদক্ষেপ অকুলান। টেনে আনতে ছিঁড়ে যায় দশা।
ঢাকায় বাসাবাড়িতে চুরি-ডাকাতিও বেড়েছে। ভুক্তভোগীরাও কারণ বুঝতে পারছে। তারা নিজ চোখেই দেখছেন পুলিশের অপর্যাপ্ত সক্রিয়তা। এ ধরনের ঘটনা নিয়ে থানায় গেলে পুলিশেরই অসহায়ের অবস্থা। ঢাকার সড়কেও পুলিশের উপস্থিতি কম। এ সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। এ চক্রের নেটওয়ার্ক বুঝে উঠতে পারছে না পুলিশ।
কয়েকটি ঘটনার কেস স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়ার চেয়ে পৈশাচিক কায়দায় জখমেও আনন্দ পাচ্ছে কিশোর বয়সী ছিনতাইকারীরা। আর এমনই একটা অবস্থা ছিনতাইয়ের পর ভুক্তভোগীর সাহায্যে এগিয়ে আসে না কেউ। একদিকে, ছিনতাইকারীদের মানসিক বিকৃতি, আরেকদিকে আশপাশের সাধারণ মানুষের নিজের আপন প্রাণ বাঁচানোর এ প্রবণতা অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।