কমলাপুর রেলস্টেশনে পকেটমার-ছিনতাইকারীর উৎপাত, থানা থেকেও চুরি

কমলাপুর রেলস্টেশনে পকেটমার-ছিনতাইকারীর উৎপাত, থানা থেকেও চুরি

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  ২৬ ডিসেম্বর বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টা। কমলাপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন ঢাকা রেলওয়ে থানায় ঢুকে দেখা যায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য কানাঘুষা করছেন। কিছুক্ষণ আগে থানার ভিতর থেকে তাদেরই একজন নারী সদস্যের মোবাইল ফোন চুরি হয়েছে। ওই নারী পুলিশ সদস্য একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন। তবে এক সপ্তাহ পার হলেও ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয়নি।

থানায় এমন ঘটনা কম ঘটলেও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে হরহামেশাই মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া যাচ্ছে রেলের যাত্রীদের। ট্রেনের ভিতর অথবা প্ল্যাটফর্ম থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে কেউ কেউ থানায় জিডি করছেন। তবে হারানো জিনিসপত্র উদ্ধার হওয়ার ঘটনা খুবই কম।

গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার উদ্দেশ্যে ঝিনাদহের কোটচাঁদপুর রেলস্টেশন থেকে পরিবারসহ বেনাপোল এক্সপ্রেসে ওঠেন মো. আবু সাঈদ। রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছায়। ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের গেটে এসে টের পান তার প্যান্টের পকেটে মানিব্যাগ নেই।

    সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদেরও পোশাক আছে, ইউনিফর্ম আছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্র্যাক্টিস নেই। নিয়ম অনুযায়ী পোশাক আছে এবং প্রতি বছর দেওয়া হয়। এরা (রেলের ক্লিনার) হয়তো সেটা ব্যবহার করে না।- বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান

মানিব্যাগে কিছু নগদ টাকার পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র, মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডসহ বেশকিছু মূল্যবান জিনপত্র ছিল। এসব মূল্যবান জিনপত্র হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ভিতরে ঢাকা রেলওয়ে থানায় জিডি করেন আবু সাঈদ। এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হলেও ওই পুলিশ সদস্যের মতো তার সেসব সামগ্রীও এখনো উদ্ধার হয়নি।
ক্লিনারের ছদ্মবেশে পকেটমার-ছিনতাইকারী

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ক্লিনার সেজে ঘুরে বেড়ায় পকেটমার ও ছিনতাইকারী। স্টেশনে কোনো ট্রেন এসে থামলেই যাত্রীরা নামার আগেই হুড়োহুড়ি করে ট্রেনের বিভিন্ন বগিতে ঢুকে পড়েন এসব পকেটমার, ছিনতাইকারী। নামার তাড়াহুড়ায় যাত্রীদের অমনোযোগিতার সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে মানিব্যাগসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে সটকে পড়েন তারা।

রেলস্টেশনের ভিতরে কে পকেটমার এবং কে ক্লিনার তা যাচাই করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পক্ষে কষ্টকর। কারণ রেলের ক্লিনারের দায়িত্ব পালনকারীরা কোনো ড্রেসকোড মেনে চলেন না। ফলে ক্লিনার পরিচয় দিয়ে খুব সহজেই প্ল্যাটফর্ম ও রেলের বগির ভেতরে ঢুকে পড়ছে পকেটমার ও ছিনতাইকারীরা।

এ বিষয়ে কমলাপুর স্টেশন এলাকায় দায়িত্ব পালন করা রেলওয়ে পুলিশের একজন সদস্য বলেন, কমলাপুর রেলস্টেশনে যারা কুলির কাজ করেন তাদের একটা ড্রেসকোড আছে। কিন্তু ক্লিনারদের কোনো ড্রেসকোড নেই। ক্লিনাররা সাধারণ মানুষের মতো ড্রেস পরেন। ফলে ক্লিনার পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ প্ল্যাটফর্মে ঘোরাঘুরি করে এবং রেলের বগিতেও উঠে পড়ে। ড্রেসকোড না থাকায় কে পকেটমার, আর কে ক্লিনার তা বোঝা যায় না। যদি ক্লিনারদের ড্রেসকোড থাকতো তাহলে স্টেশন এলাকায় হয়তো চুরি-ছিনতাই কমে আসতো।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি ক্লিনারদের ড্রেসকোড ও পরিচয়পত্র থাকা উচিত। কারণ আইডেন্টিফাই (শনাক্ত) না করতে পারলে তো বোঝা মুশকিল কে ভেতরের, কে বাইরের। ’

তিনি বলেন, ‘সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদেরও পোশাক আছে, ইউনিফর্ম আছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্র্যাক্টিস নেই। নিয়ম অনুযায়ী পোশাক আছে এবং প্রতি বছর দেওয়া হয়। এরা (রেলের ক্লিনার) হয়তো সেটা ব্যবহার করে না।’

    প্ল্যাটফর্মে ডিউটি টিম আছে, সঙ্গে একটি স্পেশাল টিম আছে, যেটা সব সময় গোয়েন্দা নজরদারি রাখে। এছাড়া কোনো তথ্য আমার নলেজে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিরসন করার চেষ্টা করি।- ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে রেলওয়ে রেঞ্জে মোট মামলা হয়েছে ৫৯১টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৪১টি, ফেব্রুয়ারিতে ৬৩টি, মার্চে ৫৪টি, এপ্রিলে ৫৩টি, মে মাসে ৫৮টি, জুনে ৪৯টি, জুলাইতে ৮০টি, আগস্টে ২৫টি, সেপ্টেম্বরে ৪৫টি, অক্টোবরে ৫৬টি, নভেম্বরে ৬৭টি মমলা হয়েছে। আগস্টের পর ধারাবাহিকভাবে মামলার সংখ্যা বেড়েছে।

জানুয়ারিতে হওয়া ৪১ মামলার মধ্যে হত্যা একটি, দস্যুতা একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি, চুরি ১২টি, মাদক উদ্ধার ১৫টি এবং অন্য ঘটনায় মামলা ১১টি। ফেব্রুয়ারিতে হত্যা মামলা ৫টি, দস্যুতা একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি, চুরি ১২টি, অস্ত্র উদ্ধার একটি, মাদক উদ্ধার ১৮টি, চোরাচালান একটি এবং অন্য ঘটনায় ২৫টি মামলা হয়।

পরের মাস মার্চে হত্যা একটি, দস্যুতা একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি, চুরি ১৩টি, মাদক উদ্ধার ২৪টি এবং অন্য ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪টি। এপ্রিলে দস্যুতা একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি, চুরি ৬টি, মাদক উদ্ধার ১৩টি এবং অন্য ঘটনায় ৩২টি মামলা হয়েছে। মে মাসে দস্যুতা ৫টি, দ্রুত বিচার আইনে একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি, চুরি ১৩টি, অস্ত্র উদ্ধার একটি, মাদক উদ্ধার ১১টি, চোরাচালান দুটি এবং অন্য ঘটনায় ২৩টি মামলা হয়েছে।

জুন মাসে হওয়া ৪৯ মামলার মধ্যে হত্যার ঘটনায় তিনটি, দ্রুত বিচার আইনে একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি, চুরি ১৬টি, মাদক উদ্ধার ১২টি এবং অন্য ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। জুলাই মাসে হওয়া ৮০ মামলার মধ্যে দস্যুতা একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন দুটি, চুরি ১২টি, অস্ত্র উদ্ধার একটি, মাদক উদ্ধার ১৪টি এবং অন্য ঘটনায় ৫০টি মামলা হয়েছে।

আগস্টের ২৫ মামলার মধ্যে চুরির ঘটনায় ১৪টি, মাদক উদ্ধার তিনটি এবং অন্য ঘটনায় ৮টি মামলা হয়। সেপ্টেম্বরে হত্যা একটি, ডাকাতি দুটি, দস্যুতা তিনটি, চুরি ১৫টি, অস্ত্র উদ্ধার দুটি, মাদক উদ্ধার ১৫টি এবং অন্য ঘটনায় সাতটি মামলা হয়। অক্টোবরে হত্যা একটি, দস্যুতা ৫টি, চুরি ১৭টি, মাদক উদ্ধার ২২টি এবং অন্য ঘটনায় ১১টি মামলা হয়। নভেম্বরে হত্যা দুটি, দস্যুতা চারটি, চুরি ছয়টি, মাদক উদ্ধার ৩৯টি, চোরাচালান চারটি এবং অন্য ঘটনায় ১২টি মামলা হয়েছে।

এ বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশ ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত দিনের তুলনায় আমাদের মামলার সংখ্যা কমেছে। ছিনতাই কমেছে, পকেটমার কমেছে। ডাকাতি হয়েছিল বহু আগে।’

কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিতরে অবস্থিত রেলওয়ে থানার ভিতর থেকে একজন পুলিশ সদস্যের মোবাইল চুরি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কেউ নিয়েছে নাকি তার সহকর্মীরা নিয়েছে, না হারিয়ে গেছে, না চুরি হয়েছে তা তো বলতে পারি না। আমার হিসাবে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি অনেক কমেছে।’

যোগাযোগ করা হলে থানার ভিতর থেকে একজন নারী পুলিশ সদস্যের মোবাইল ফোন চুরি হওয়ার ঘটনাটি স্বীকার করেন ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি জিডি হয়েছে। তবে মোবাইল ফোনটি এখনো উদ্ধার হয়নি। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যবহার না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়াটা মুশকিল।’

রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ছিনতাই, পকেটমার প্রতিরোধে আপনারা কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এজন্য প্ল্যাটফর্মে ডিউটি টিম আছে, সঙ্গে একটি স্পেশাল টিম আছে, যেটা সব সময় গোয়েন্দা নজরদারি রাখে। এছাড়া কোনো তথ্য আমার নলেজে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিরসন করার চেষ্টা করি।’