শিল্পকর্মে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি,প্রদর্শনী

শিল্পকর্মে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি,প্রদর্শনী

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  এই অঞ্চলে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছিল। শাসকদের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, সুন্দরবনের বাদা (বন-জঙ্গল) কেটে যে যত জমি নিজেদের অধিকারে নিতে পারবে ততটুকুই তার জমি হিসেবে বরাদ্দ করা হবে। বৃহত্তর খুলনার দাকোপ, কয়রাসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ঘোষণার বেশ প্রভাব পড়ে। কিন্তু বাস্তুসংস্থানের সমাধান মিললেও সংকট তৈরি হয় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের।
 

বসবাসের প্রয়োজনে বন কেটে বসতি স্থাপনের এই কাজকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘হাত কাটালি’।

ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে ‘হাত কাটালি’ শিরোনামে আয়োজন করা হয়েছে এক শিল্প প্রদর্শনীর। শিল্পী বিশ্বজিত রায়ের একক এই শিল্প প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি। পিতা ও পিতামহের কাছ থেকে শুনে আসা হাত কাটালির গল্প আর নিজের দেখা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও লোককাহিনিকে শিল্পের মাধ্যমে প্রতীকীভাবে হাজির করেছেন তিনি।

ভিনদেশি রাজনীতির প্রভাবে সুন্দরবনের প্রায় ২০ প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তির ইতিহাসের সাক্ষী গণ্ডারকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী।
 

প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, গ্যালারির মেঝে ও দেয়ালে বড় তিনটি শিল্পকর্ম ছাড়াও কয়েকটি ছোট শিল্পকর্ম জায়গা পেয়েছে। গ্যালারিতে ঢুকলেই নজর আটকে যায় বাঁ দিকের দেয়ালে। পোড়ামাটিতে হাতের ছাপ বসিয়ে দেয়ালজুড়ে শৈল্পিক রুচিতে সেঁটে দেওয়া হয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে গরুর গোবরে হাতের ছাপ দিয়ে গৃহিণীরা যেভাবে তৈরি করেন জ্বালানি, দেখতে অনেকটা তেমন। শিল্পী জানালেন, বনকেন্দ্রিক লোকজীবনের সহজাত বিশ্বাস, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের অস্তিত্বের স্বরূপ বোঝাতেই এই প্রতীক শিল্প নির্মাণ করেছেন তিনি।

গ্যালারির সুপরিসর মেঝেতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন থেকে আনা ভেজা মাটি। তার ওপর রাখা হয়েছে সিরামিকে তৈরি সুন্দরবনের বিলুপ্ত প্রাণিকুল। বেশ কিছু ছোট-বড় গণ্ডার সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে।

প্রাচীন সুন্দরবনের যে অংশ কেটে বর্তমান খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হয়েছে, একসময় তা ছিল গণ্ডারের বিচরণভূমি। এখন সেখানে গণ্ডারের অস্তিত্ব নেই। কালের বিবর্তনে মানুষের আধিপত্যে বন্য প্রাণী ও বনভূমির অস্তিত্বের সংকট যে দিন দিন প্রকট হচ্ছে, সেটি প্রদর্শনীর শিল্পকর্মে উপস্থাপন করা হয়েছে।

গণ্ডারের একেবারে সামনেই সুন্দরবনে জন্ম নেয় এমন গাছের গুঁড়ি ও ফসিল দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি বৃহৎ শিল্পকর্ম। এভাবে সিরামিক, পোড়ামাটি আর সুন্দরবনের প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ দিয়ে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে প্রদর্শনীটি।

শিল্পী বিশ্বজিত রায়ের জন্ম সুন্দরবনসংলগ্ন চান্নিরচক গ্রামে। সুন্দরবন অঞ্চলে বহুল শ্রুত পৌরাণিক আখ্যান এবং জল-হাওয়ার গল্প নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাই সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিকে প্রদর্শনীতে তিনি তুলে এনেছেন। রূপক শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্যকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন। নানা কারণে সুন্দরবনের ঐতিহ্য বেঙ্গল টাইগার ও অন্যান্য প্রাণী বিলুপ্তির পথে। এসবই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁর শিল্পকর্মে।

গতকাল রবিবার শিল্পী ও সমালোচক মোস্তফা জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, “এই ধরনের কাজকে বলা হয় ‘সোশ্যালি এমবেডেড আর্ট’। অর্থাৎ সামাজিক সত্য, পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত শিল্পকর্ম। এটা এক ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক শিল্প নির্মাণ। আমরা জানি, এই বদ্বীপ এক ধরনের জঙ্গল বা সোয়াম্প এরিয়া ছিল। কেটে পরিষ্কার করে করে জনবসতি হয়েছে। বিশ্বজিতের শিল্প সেই স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করছে।”

আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত। বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করা যাবে।