ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক: তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো নিয়ে নতুন প্রস্তাব

প্রথম নিউজ, অনলাইন: ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোতে অনেকটাই একমত পোষণ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। কমিশনের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো নিয়ে সংশোধিত প্রস্তাবের বিস্তারিত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেয়া হয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ড. আলী রীয়াজ রাজনৈতিক দলগুলোকে দলগতভাবে আলোচনা করে সোমবার ঐকমত্য কমিশনের কাছে তাদের মতামত লিখিত আকারে জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোর ঐকমত্যের বিষয়ে আগামী মঙ্গলবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে ড. আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সমস্ত রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত। তারা সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদ সংশোধনে একমত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব চেয়েছিলাম। চারটি রাজনৈতিক দল তাদের প্রস্তাবগুলো আমাদের কাছে দিয়েছে। ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমরা সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছি আজকে। সংশোধিত প্রস্তাবে বিস্তারিতভাবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ পদ্ধতির বিষয়ে বলা হয়েছে। এ প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে লিখিত প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেয়া হয়েছে। তারা খসড়া প্রস্তাবটি দলগতভাবে আলোচনা করে আগামীকাল আমাদের কাছে মতামত দিবেন। তারই প্রেক্ষিতে আগামী মঙ্গলবার আমরা একমত হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারবো। তিনি আরও বলেন, উচ্চ কক্ষের বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই তবে কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে একমত হয়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে আরও দু’-একদিন সময় লাগবে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারবো।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আজকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো ও প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন কিনা এসকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা ও তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধি থাকার বিষয়ে সকল দল একমত পোষণ করেছে। সেখানে তাদের দেয়া সুপারিশের ভিত্তিতে শর্ট লিস্টিং করে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হতে পারে। যদি সেখানে ঐকমত্য না হয় তাহলে র্যাংক চয়েস এর মাধ্যমে নিয়োগ হবে। তার বিধান নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো নিয়ে সংশোধিত প্রস্তাবের বিস্তারিত খসড়া আজকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেয়া হয়েছে। আমরা সেগুলো দলগতভাবে আলোচনা করে আগামীকাল কমিশনের কাছে আমাদের মতামত লিখিত আকারে দেবো। যেন বাছাই কমিটি এমন একজন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন, যার বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি থাকবে না। এ ছাড়া একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী এবং দলের প্রধান পদে থাকতে পারবে কিনা এ বিষয়ে কিছু বিতর্ক হচ্ছে, তবে দলগুলো কাছাকাছি মতে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান আমরা বিগত সময়ে লিখিত আকারে জানিয়েছি। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্যে একই ব্যক্তি দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়ে আগামীকাল আলোচনা হবে।
জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে, এরমধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগে ৭ জন ও ৫ জন সদস্যবিশিষ্ট বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে। আমরা দু’টি প্রস্তাবেই একমত, এক্ষেত্রে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবে। যদি তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারেন তাহলে র্যাঙ্ক চয়েস ভোটের মাধ্যমে নিয়োগ হবে। এখানে বিএনপি’র প্রস্তাব ছিল যদি র্যাংক চয়েস ভোট হয় তাহলে তৃতীয় বৃহত্তম দল ভোট দিতে পারবে না। আমরা এর বিরোধিতা করেছি, আমরা বলেছি কমিটির সকল সদস্যের ভোটের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ হবে। তিনি আরও বলেন, সংসদের সকল দলের পক্ষ থেকে যেন প্রধান উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করা হয় সেজন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। কমিশনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত খসড়া দেয়া হয়েছে আমরা সেগুলো দলগতভাবে আলোচনা করে মতামত দেবো। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিশন থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী, দলের প্রধান ও লিডার অব দ্য হাউজের পদের যেকোনো একটিতে একজন ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আমরা বলেছি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও লিডার অব দ্য হাউজের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তা নাহলে অচল অবস্থা তৈরি হতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী, দলের প্রধান ও সংসদ নেতা এ তিনটি পদের মধ্যে একজন ব্যক্তি যেন যেকোনো একটিতে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যে, সংসদ অবসনের ৩০ দিন পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে হবে। ৭ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। তাদের প্রস্তাব অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল সংসদে যারা ১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন তাদেরও বাছাই কমিটিতে রাখতে হবে। কোনো কারণে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে ব্যার্থ হলে র্যাঙ্ক চয়েস ভোট হবে। এ বিষয়ে আগামী মঙ্গলবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তিনি আরও বলেন, একজন ব্যক্তি একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এ বিষয়ে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি।
বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন ছাড়াও সিপিবি, বাসদ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য, জাসদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণফোরামসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।