বঙ্গোপসাগরে মৃত্যুফাঁদ, বিলুপ্তির শঙ্কায় পান্না কাছিম

সবশেষ শুক্রবার একদিনেই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসে ২৪টি মৃত মা কাছিম। যাদের প্রতিটির পেটে ছিল ডিম।

 বঙ্গোপসাগরে মৃত্যুফাঁদ, বিলুপ্তির শঙ্কায় পান্না কাছিম

প্রথম নিউজ, ঢাকা: অলিভ রিডলে সি টার্টল বা জলপাইরঙা সাগর কাছিম। পান্না কাছিম নামে আছে আলাদা পরিচিতি। বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূল এ প্রজাতির কাছিমের অন্যতম প্রজননক্ষেত্র। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মা পান্না কাছিমের দল ডিম দিতে ছুটে আসে কক্সবাজার উপকূলে। কিন্তু এবারের প্রজনন মৌসুমটি মা কাছিমদের জন্য যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে।

২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী, কাছিমের এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত হলেও শুধু গত দুই মাসে কক্সবাজার উপকূল থেকেই শতাধিক মা পান্না কাছিমের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। সবশেষ শুক্রবার একদিনেই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসে ২৪টি মৃত মা কাছিম। যাদের প্রতিটির পেটে ছিল ডিম।

গবেষক ও স্থানীয় জেলেরা জানান, সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০ অনুসারে বাণিজ্যিক ট্রলারগুলো ৪০ মিটারের অধিক গভীরতায় মৎস্য আহরণ করতে পারে। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, চলতি মৌসুমে বাণিজ্যিক ট্রলারগুলো আইন না মেনে নির্ধারিত গভীরতার ওপরে যত্রতত্র মৎস্য আহরণ করছে। ফলে জালে আটকে আহত ও মারা যাচ্ছে ডিম দিতে আসা মা পান্না কাছিম।
এছাড়া অনুমোদহীন ট্রলার ও জাল ব্যবহার করে মাছ শিকারের কারণে বঙ্গোপসাগরে এ প্রজাতির কাছিম বিলুপ্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ভেসে আসা সামুদ্রিক প্রাণীর মরদেহের নমুনা সংগ্রহ করে তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৮৩টি মৃত মা কাছিম ভেসে আসার তথ্য পেয়েছি। তবে মৃত কাছিমের প্রকৃত সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি।’

জলপাইরঙা সাগর কাছিম বিশ্বজুড়ে গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার উপকূলে দেখা যায়। নভেম্বর থেকে মার্চ অলিভ রিডলি টার্টেলের প্রজননের সময়কাল। স্ত্রী কাছিম হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাদের জন্মস্থানে ফিরে আসে ডিম পাড়তে। রাতে জোয়ারের সময় কাছিমেরা সমুদ্রতটে উঠে বালি খুঁড়ে তাদের বাসা বানায় ও গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ১৬০টি ডিম পাড়ে। শিকারিদের থেকে ডিমগুলো বাঁচানোর জন্য তারা তাদের বাসা বালি চাপা দিয়ে দেয়। তবে এবার অবৈধভাবে উপকূলের কাছাকাছি চলে আসা বাণিজ্যিক ট্রলারের জালে আটকে ও নানাভাবে মা কাছিমদের করুণ মৃত্যু হচ্ছে।

শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কের উখিয়া উপজেলার সোনার পাড়া থেকে টেকনাফ সৈকত এবং মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া উপকূলে ভেসে আসে ২৪টি মৃত মা কাছিম। যাদের অধিকাংশের পেটেই ডিম পাওয়া গেছে। গতকাল পর্যন্ত ৭৮টি মৃত মা পান্না কাছিম থেকে ৯ হাজার ১০৭টি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।

বিজ্ঞানী তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যেসব মৃত কাছিম উদ্ধার করেছি তার অধিকাংশের স্লিপার কাটা পেয়েছি। এছাড়া গলায় ফাঁস ও হাত-পা কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন কাছিমও পেয়েছি। মূলত জালে আটকে পড়া মা কাছিমদের এভাবে নির্দয়ভাবে আহত করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যারা দু-এক সপ্তাহ পর্যন্ত কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছে। পরে পচা-গলা মা কাছিমের মরদেহ ভেসে আসছে সাগর তীরে। ‘নিয়ম অনুযায়ী বাণিজ্যিক ট্রলারে টার্টল এক্সক্লুডার ডিভাইস (টিইডি) ব্যবহারের কথা থাকলেও সেটি ব্যবহার না হওয়ায় এবং জালে আটকে পড়া কাছিম ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা না থাকায় মা কাছিমরা নির্দয়ভাবে মারা যাচ্ছে।’, বলেন বিজ্ঞানী তরিকুল ইসলাম।

বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এসকে আবিদ হুসাইনের দাবি, ৪০ মিটারের অভ্যন্তরে কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ মাছ শিকার করে না। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন উপকূলের বাইরে আমাদের ট্রলারগুলো মাছ শিকার করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিংড়ি ধরার জন্য বটম ট্রলিং (সাগরের তলদেশে) করা হয়। আর কাছিম হলো সাগরের মধ্যস্তরের প্রাণী। তাই আমাদের জালে পড়ে কাছিমের মৃত্যুর বিষয়টি সত্য নয়।’

‘দু-একটি কাছিম যদি জালে আসে, তা টার্টল এক্সক্লুডার ডিভাইস দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। না জেনে অভিযোগ তোলা হলে আইইউসিএনসহ প্রকৃতির সুরক্ষা নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশ্ন তুলে আমাদের মাছ ধরাই বন্ধ করে দেবে। তা দেশের জন্য ভালো হবে না।’ বলেন এসকে আবিদ হুসাইন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘বাণিজ্যিক ট্রলার নয়, বরং কক্সবাজার উপকূলে নতুন কিছু ফিশিং বোট চালু হয়েছে। যারা ৪০ মিটারের ভেতরে-বাইরে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরছে। এছাড়া তারা অনুমোদনবিহীন দ্রুতগতির ইঞ্জিন ব্যবহার করছে। মূলত এ কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মা কচ্ছপরা।’

 চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন উপকূলে গত ২০ বছর ধরে মাছ ধরেন ছালেহ আহমদ। তিনি  বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে একটা পিঁপড়াও আমরা মারি না। কিন্তু বড় বড় জাহাজ থেকে ফেলা জালে অনেক মা কচ্ছপ মারা যাচ্ছে। এসব জাহাজের জেলেরা কচ্ছপ জালে জড়িয়ে গেলে অনেক সময় জাল রক্ষা করার জন্য সেগুলোকে মেরে ফেলে, অথবা জাল কেটে ভাসিয়ে দেয়। পরে জাল ছাড়াতে না পেরে সাগরেই ওগুলোর মৃত্যু হয়।’

সম্প্রতি সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গিয়ে একই চিত্র দেখতে পান গবেষক ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম। তিনি বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের সৈকতে বেশ কয়েকটি মা কাছিমের মরদেহ দেখেছি। এসব কাছিমের অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে সাত থেকে আটদিন আগে, তবে তাদের শরীরের ক্ষতগুলো তখনো স্পষ্ট ছিল।’

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পান্না কাছিম প্রজননের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সেগুলো হলো- অবৈধ মৎস্য আহরণ, নিষিদ্ধ কারেন্ট ও টানা জালের ব্যবহার, সমুদ্রতীরে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রজননক্ষেত্র আলোকায়ন, জেলেদের জালে আটকা পড়ার পর মেরে ফেলা ও ট্রলার বা জাহাজের ধাক্কায় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘আমরা এর আগে কখনো একসঙ্গে এত বেশি কাছিমের মৃত্যুর খবর পাইনি। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, উপকূলে প্রাণীর বিচরণ ও বাসস্থানে কোনো বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে দেখা উচিত। তিনি বলেন, ‘পান্না কাছিম সাগরের বাস্তুসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব কাছিমের খাবার হলো জেলি ফিশ। একইভাবে জেলি ফিশের খাবার সাগরের বিভিন্ন ছোট মাছ। এ অবস্থায় কাছিমের বিলুপ্তি হলে পুরো খাদ্যশৃঙ্খলে বিপর্যয় নেমে আসবে।’

বৈশ্বিক সমীক্ষা অনুযায়ী আনরিপোর্টেড অ্যান্ড আনরেগুলেটেড (আইইউইউ) দমনে ২০টি এশিয়ান দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ এবং বিশ্বে ১৫২টি দেশের মধ্যে ৮৫তম। সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘আইইউইউ ফিশিংয়ের প্রভাব কেবল পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং সামগ্রিক মেরিটাইম সিকিউরিটিতে হুমকি তৈরি হচ্ছে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর, চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ড. মো. খালেদ কনক বলেন, ‘আমরা যেসব জাহাজকে মাছ ধরার অনুমতি দেই, তাদের উপকূলের ৪০০ মিটারের অভ্যন্তরের মাছ ধরার অনুমতি নেই। যদি কেউ করে তাহলে তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়। নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘লাইসেন্সপ্রাপ্ত জাহাজগুলো ৪০০ মিটারের অভ্যন্তরে মাছ ধরছে কি না তা তদারকির জন্য নিয়মিত রেজার ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের নেই। শুধু নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ড থেকে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

অবৈধ ফিশিং ছাড়াও অবহেলার কারণে জেলেদের ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত জালে জড়িয়েও মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে। ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির তথ্যমতে, বাংলাদেশের জলসীমায় শুধু ফেলে দেওয়া জাল বা গোস্ট নেটে জড়িয়ে ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘গোস্ট নেট একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর ও দেশের নদীগুলোতে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। জেলেরা অসচেতনভাবে অনেক টুকরো জাল সাগর বা নদীতে ফেলে দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের অপারেশনের সময় অবৈধ জালগুলো কেটে সাগর বা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এসব জাল সাগরে ভাসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে এ জালগুলোতে শ্যাওলা জন্মে এবং বিভিন্ন ছোট ছোট মাছ ও শামুক বাসা বাঁধে। এগুলো দেখেই অবুঝ কাছিম খাবার ভেবে খাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় ওই টুকরো জাল মুখে ও দাঁতে জড়িয়ে তাদের শ্বাসরোধ করে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে প্রাণীটির মৃত্যু হয়।’