মাতৃত্বকালীন ছুটি পর্যাপ্ত মনে করেন না কর্মজীবী নারীরা

সরকারি খাতে কর্মজীবী মায়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস পেলেও বেসরকারি খাতে কর্মজীবীরা তা পাচ্ছেন না।

মাতৃত্বকালীন ছুটি পর্যাপ্ত মনে করেন না কর্মজীবী নারীরা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো এবং পরিচর্যার জন্য মাতৃত্বকালীন যে ছুটি দেওয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন কর্মজীবী নারীরা। এর ওপর আবার সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মরত নারীদের মধ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে রয়েছে বৈষম্য। সরকারি খাতে কর্মজীবী মায়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস পেলেও বেসরকারি খাতে কর্মজীবীরা তা পাচ্ছেন না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীরা যতদিন মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছেন সেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটিও প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ অবস্থায় মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন কর্মজীবী নারীরা।

২০১১ সালের জানুয়ারিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। সরকারি চাকরিতে কর্মরত নারীরা সেসময় থেকে এ ছুটি পেয়ে আসছেন। এরআগে তারা মাতৃত্বকালীন ছুটি পেতেন চার মাস। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত একজন নারী তার চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ দুইবার এই সুযোগ পাবেন। সরকারি চাকরি বিধি (পার্ট-১) ১৯৭ ধারার উপধারা ১ সংশোধন করে এ বিধান করা হয়েছে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়।  সাধারণত একটি বাচ্চা ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খায়। কিন্তু একজন মা সন্তান জন্মের একমাস আগে ছুটি নিলে বাচ্চার পাঁচ মাস বয়সে তাকে চাকরিতে যোগ দিতে হয়। একটি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হয় ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পর পর। কিন্তু মা চাকরিতে ফিরলে সেটি সম্ভব হয় না। সাধারণত সন্তান জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত তাকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হয়। পরবর্তী সময়ে বাড়তি খাবার হিসেবে বাচ্চারা অন্য খাবার খেতে পারে।

কর্মজীবী নারীরা বলছেন, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বের শারীরিক জটিলতার কারণে অনেক সময় এক মাস আগেই মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যেতে হয়। ছুটি শেষে কাজে যোগদান করার সময় বাচ্চার বয়স ছয় মাসেরও কম থাকে। সেক্ষেত্রে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং পর্যাপ্ত পরিমাণে দেওয়া সম্ভব হয় না। অথচ বাচ্চা জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত তার বেড়ে ওঠার সহায়ক হিসেবে এটি কাজ করে। ফলে এ সময়ে শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠায় বাধা সৃষ্টি হয়। বেসরকারি কর্মজীবীদের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি আরও কম। ফলে আরও বেশি জটিলতায় পড়তে হয় তাদের। শরীয়তপুরের ৮২নং দক্ষিণ পাঁচকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস হলে আমাদের একটু সমস্যা হয়। সন্তান জন্মের আগে শারীরিক সমস্যার কারণে ১৫ দিন কিংবা এক মাস আবার অনেকের আরও আগে ছুটি নিতে হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস হওয়ায় মা চাকরিতে যোগদান করার সময় বাচ্চা অনেক ছোট থাকে। সাধারণত একটি বাচ্চা ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খায়। কিন্তু একজন মা সন্তান জন্মের একমাস আগে ছুটি নিলে বাচ্চার পাঁচ মাস বয়সে তাকে চাকরিতে যোগ দিতে হয়। তিনি বলেন, সাধারণভাবে একটি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হয় ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পর পর। কিন্তু মা চাকরিতে ফিরলে সেটি সম্ভব হয় না। দেখা যায় বাচ্চাকে সেভাবে সময় দিতে পারেন না। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারছেন না, টেনশন কাজ করে। সবমিলিয়ে কর্মজীবী মায়েদের অনেক সমস্যা হয়। ওই সময়ে তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না।

মাহমুদা আক্তার আরও বলেন, একজন কর্মজীবী মায়ের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি এক বছর হলে ভালো হয়। তাহলে বাচ্চাটা একটু বড় হয়। যদিও চাকরিজীবী মায়েদের একটু সমস্যা সবসময়ই হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছোট বাচ্চা রেখে চাকরিতে মনোযোগ দেওয়া খুবই কষ্টকর। আশা করি মাতৃত্বকালীন ছুটি এক বছর হবে। সেটি সম্ভব না হলেও বর্তমানের চেয়ে একটু বাড়িয়ে দিলে খুব ভালো হয়।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের নার্সিং অফিসার সাবরিনা পারভীন প্রান্ত। আট মাস বয়সী একটি ছেলে সন্তান রয়েছে তার। মাতৃত্বকালীন চার মাসের ছুটি পেয়েছিলেন তিনি। তবে সেটি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন এই নার্সিং অফিসার। সাবরিনা বলেন, আমরা যেহেতু কর্মজীবী মা, তাই সন্তানকে সময় দেওয়াটা এবং সন্তানের সঙ্গে থাকা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। তবে আমরা মাতৃত্বকালীন যে ছুটি পাই সেটা একজন মা ও বাচ্চার জন্য পর্যাপ্ত না। কারণ একজন নারী যখন প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড পার করে মা হন, এসময় তার অনেক হরমোনাল পরিবর্তন হয়। যেহেতু মায়েরা বুকের দুধ পান করান, বাচ্চার তো ছয় মাস শুধুমাত্র বুকের দুধই খেতে হবে। কিন্তু একজন মা যখন প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করেন তখন তাকে চার মাসের ছুটি শেষে কাজে যোগ দিতে হয়। সরকারি চাকরি হলে এক্ষেত্রে ছুটি থাকে ছয় মাস।

তিনি বলেন, চার মাস পর মা চাকরিতে যোগদান করলে বাচ্চাকে কৌটার দুধ খাওয়ানো হয়, অথবা ছয় মাস হওয়ার আগেই বাইরের খাবার খাওয়াতে হয়। একটা সময় গিয়ে বাচ্চার স্টোমাক পরিপূর্ণ হয় না (ক্ষুধা মেটে না)। তখন তাদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ার মতো সমস্যা হয়। এর ফলে মায়ের মধ্যেও বিষণ্নতা কাজ করে, যেহেতু তার বাচ্চা একদমই ছোট। বাচ্চা খাবার পাচ্ছে না বলে সমস্যা হচ্ছে, তাই ওই মা অফিসে গিয়ে কাজে সঠিকভাবে সময় দিতে পারেন না এবং কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে ছুটি এক বছর হলে খুবই ভালো হয়। কারণ এই সময়ের মধ্যে একটা বাচ্চা কিছুটা পরিপূর্ণ হয়। সে সময় বাচ্চা একটু হাঁটার চেষ্টা করে, বসতে পারে, একটু পরিপক্ক হয়। অবশ্যই একজন মায়ের জন্য এক বছর ছুটি পেলে সবচেয়ে ভালো হয়।

এ বিষয়ে অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, আমি মনে করি ছয় মাস ছুটি ঠিক আছে। আমাদের দেশের অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন কিন্তু তিন মাসের বেশি ছুটি দেয় না। অনেক নারী বাচ্চা হওয়ার এক-দুইদিন আগে ছুটি নেন, তিন মাস ছুটি কাটিয়ে আবার দুই মাস ছুটি নেন। সবাই কিন্তু ছুটিটা এই সময়ই কাটায়। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ছুটিতে থাকাকালীন তাকে ফুল পেমেন্ট দিতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত ছুটি কাটানোর পর অনেকে দুই মাস ছুটি নেয়। সেক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিনা বেতনে ছুটি দেয়। বাচ্চা হওয়ার পর অনেক ধরনের জটিলতা থাকে। অনেক সময় পরিবারে বাচ্চাকে দেখার মতো লোকজন থাকে না, সে জন্য মায়ের ছুটি দরকার হয়। এনজিওর ক্ষেত্রে ছুটি নিয়ে তেমন সমস্যা হয় না। তবে করপোরেট সেক্টরে কিন্তু এত বেশি ছুটি দেয় না। একজন নারী যখন প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড পার করে মা হন, এসময় তার অনেক হরমোনাল পরিবর্তন হয়। যেহেতু মায়েরা বুকের দুধ পান করান, বাচ্চার তো ছয় মাস শুধুমাত্র বুকের দুধই খেতে হবে। কিন্তু একজন মা যখন প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করেন তখন তাকে চার মাসের ছুটি শেষে কাজে যোগ দিতে হয়। 

ওয়াহিদা বানু বলেন, জাপানে নারীদের সঙ্গে আমাদের একটি প্রোগ্রাম ছিল। তাদের সবার বয়স ৩০-৩৫ বছর। তাদের কাছে জানতে চাইলাম আপনাদের কতজন বিবাহিত এবং কতজন অবিবাহিত। তারা হেসে বললেন, ‘তুমি জানো না, করপোরেট সেক্টরে আমাদের চাকরি দেয় না। চাকরি দিলেও তিন মাসের গ্যারান্টি দিতে হয় যেন আমরা প্রেগন্যান্ট না হই। এ সময়ের মধ্যে যদি প্রেগন্যান্ট হই তাহলে চাকরি চলে যাবে, সেই শর্তে চাকরি হয়।’ একেক দেশে একেক সরকারের নিজের মতো পলিসি থাকে। আমাদের কোনো শিক্ষকের বাচ্চা হলে তার ছুটিকালীন আরেকজন শিক্ষক বদলি হিসেবে রাখতে হয়। কিন্তু সেই শিক্ষকের টাকা যদি ডোনার না দেয় এবং আমার যদি সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকে তাহলে আমি হয়তো তাকে চাপ দেই সবকিছু ম্যানেজ করে বাচ্চা নিয়ে ক্লাস করানো যায় কি না।

‘এখন এটি বৈশ্বিক বিষয়। যারা এখনো ছয় মাস ছুটি দিচ্ছে না, তিন মাস বা চার মাস ছুটি দিচ্ছে- তাদের বিষয়ে আগে এনশিওর হতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমার কাছে কয়েকটি তথ্য রয়েছে যে নামকরা ইনস্টিটিউশন কর্মীদের বাচ্চা হওয়ার তিন মাসের মাথায় জয়েন করতে বলে। যদি জয়েন না করে তাহলে বেতন পায় না। আবার কেউ যদি তারপরও দুই মাস বাড়তি ছুটি নিতে চায় সেক্ষেত্রে বলা হয় সেই দুই মাসের বেতন লোন হিসেবে দেওয়া হবে, যা পরবর্তীতে চাকরিতে যোগদান করলে পরিশোধ করতে হবে।’

অনেক জায়গায় অনেক ধরনের প্র্যাকটিস হয়, যা আমরা বাইরে থেকে দেখি না। তাই শিশু জন্মের পর কী ধরনের সুযোগ সুবিধা মায়েরা পান সে বিষয়ে সরকারিভাবে একটি স্টাডি হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, ছয় মাস যেন ছুটিটা পায়। ব্রেস্ট ফিডিংয়ের (ছয় মাস) সময় পার হওয়ার পর বাচ্চারা স্বাভাবিক খাবার খেতে পারে। অন্তত এতটুকু নিশ্চিত করলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাবো, যোগ করেন ওয়াহিদা বানু।