সংসদের উচ্চ কক্ষ গঠন নিয়ে ঐকমত্য হয়নি

প্রথম নিউজ, অনলাইন: সংসদের নারী আসনে প্রতিনিধিত্ব ঠিক করতে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনায়ও সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংসদে ১০০ নারী আসন এবং উচ্চ কক্ষের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও উচ্চ কক্ষে নারী আসন কী পদ্ধতিতে নির্ধারিত হবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন মত দেখা গেছে। ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, এ বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি বিধায় পুনরায় বৈঠকে বসা হবে। কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য স্থায়ীভাবে ১০০ আসন করার ব্যাপারে সব দল একমত হয়েছে। এক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত প্রশ্ন রয়ে গেছে। পদ্ধতি নির্ধারণে এখনো একমত হওয়া যায়নি। সোমবার বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৩তম দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, উচ্চ কক্ষ গঠনের ব্যাপারেও ঐকমত্য হওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কমিশন থেকে দু‘টি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায়ও কিছু কিছু প্রস্তাব এসেছে, তাই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে এখন নারী আসন বিষয়ে বিরাজমান ব্যবস্থা সংবিধানের ৬৫নং অনুচ্ছেদে আছে। কমিশন বলেছে, নিম্ন কক্ষে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করে ১০০টি আসন করা হবে। এই নারী আসনের বিষয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল পদ্ধতিগত বিষয়ে এখনো একমত হতে পারেনি। পদ্ধতি হচ্ছে- সরাসরি নারী আসনে নির্বাচন হতে পারে। এর বাইরেও আসন সংখ্যার সংখ্যানুপাতেও হতে পারে। সেটাকে বৃদ্ধি করে ১০০ আসনে নিয়ে যাওয়ার কথা প্রস্তাব আছে। এ দুটোকে সামনে নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু ঐকমত্যের জায়গায় আসা যাচ্ছে না, সেহেতু গত কয়েকদিনের আলোচনার প্রেক্ষিতে কমিশনের পক্ষ থেকে একটি বিকল্প প্রস্তাব হাজির করা হয়েছিল, যা ছিল- সব রাজনৈতিক দল, ২৫টি আসনের বেশি যে দলগুলো মনোনয়ন দেয় তাদের মোট প্রার্থীর মধ্যে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ফলে আমরা এ জায়গায় একমত হতে পারিনি।
গতকাল রাজনৈতিক দলগুলো দুইটি পদ্ধতিতেই আলোচনা করেছেন। দুইটি পদ্ধতিতে যেহেতু কয়েক দফায় আলোচনা করেও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে নতুন আরেকটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যদিও কোনো রাজনৈতিক দলই সে পদ্ধতির বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। উচ্চ কক্ষের আসন বিন্যাসের বিষয়ে দুই রকম প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলো দিয়েছে। একটি হলো- মোট ভোটের আনুপাতিক হারে, অর্থাৎ পিআর পদ্ধতিতে হবে, আরেকটি পদ্ধতি হলো- নিম্ন কক্ষের আসন বিন্যাস অনুযায়ী উচ্চ কক্ষের প্রতিনিধিত্ব ঠিক হবে। এর বাইরে কমিশনের নতুন একটি পদ্ধতি হলো- ৬৪ জেলা ও ১২ সিটি করপোরেশনের মধ্য থেকে ৭৬ জন প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে।
বৈঠক শেষে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১০০ আসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একমত হলেও, সেসব পদে সরাসরি নির্বাচনের বিপক্ষে বিএনপি। তিনি বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয় এর আগেও দুইদিন আলোচনা হয়েছে। নারী আসন নিয়েও আংশিক আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি ও ক্ষমতায়নের জন্য বিএনপি অনেক ভূমিকা রেখেছে। নারীদের জন্য বিদ্যমান ৫০ আসনকে দ্বিগুণ করার জন্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া বিদ্যমান যে ব্যবস্থা আছে আমরা মনে করি তা এখনো বহাল রাখা উচিত। কেননা, সরাসরি নারী আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রস্তাব সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল, সেখানে কিছু কিছু প্রস্তাব আছে বাস্তবায়ন করা প্রায় দুরূহ। একটা রোটেশন পদ্ধতির কথা শোনা গেছে সেটা সম্ভব না। কমিশন এখন অবশ্য সে পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে। আরেকটি পদ্ধতি ছিল- বিদ্যমান আসন ১০০ যদি হয় সে আসন শুধু নারীদের দেয়া হবে। কিন্তু সে আসন কীভাবে ঠিক করবে সেটা পরিষ্কার নয়।
ঐকমত্য কমিশনের নতুন পদ্ধতির বিষয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, আরেকটি নতুন পদ্ধতি আজ (গতকাল) উঠে এসেছে- বিদ্যমান আসনের ৩৩ শতাংশ আসনের নারীর প্রার্থিতা। যা প্রায় ১০০ হবে, আমরা যেখানে এখনো রাজনৈতিক দলসমূহ কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারিনি। আলোচনার মধ্যদিয়ে যদি কোনো গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব পাওয়া যায়, সেটি আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করবো। জাতি গঠনে নারীরা যাতে অবদান রাখতে পারে, আমরা উচ্চ কক্ষের কথা বলেছি। এখানে সরাসরি নির্বাচন এবং পিআর পদ্ধতির প্রস্তাব আমরা করিনি। কক্ষের আসনের অনুপাতে তারা নির্ধারিত হবে এবং তাদের ক্ষমতা ও কার্যাবলী নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে পিআর সিস্টেমে পিআর বাই ভোটার্সের পক্ষে আমরা খুব শক্তভাবে মত দিয়েছি। উচ্চ কক্ষ গঠনে আনুপাতিক পদ্ধতি চায় দল। তবে তা হতে হবে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে। নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়েও একমত আমরা। তবে তাও হতে হবে ভোটের পদ্ধতি অনুযায়ী। পিআর পদ্ধতিতে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করি। তিনি বলেন, কমিশন দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল। পিআর পদ্ধতিতে ভোটের কথা কমিশন বলেছে। দুই তৃতীয়াংশের বেশি দল এ প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে। তাছাড়া, যদি সরাসরি নির্বাচন হয়, তাহলে তিনটি সংসদীয় আসনে একজন নারী নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব। সে জন্য আমরা বলেছি, এটাও পিআর সিস্টেমে হবে, ১০০ জন নারী সদস্য থাকবেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে বলে নীতিগতভাবে মনে করি। পদ্ধতিগত জায়গায় এখনো কোনো সমাধান না আসলেও নীতিগতভাবে আমরা একমত যে সংসদে ১০০ নারী আসন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। সংসদে উচ্চ কক্ষের বিষয়ে উপস্থিত অধিকাংশ দল কার্যকর উচ্চ কক্ষের বিষয়ে সকলের মতামত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা মনে করি উচ্চ কক্ষের ব্যাপারে খুব সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা যার মাধ্যমে একক আধিপত্তের বিষয়টি থাকবে না, এবং যে দলটি এক শতাংশ ভোটও পেয়েছেন, তাদেরও একজন প্রতিনিধি উচ্চ কক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবেন। উচ্চ কক্ষ অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে প্রতিনিধিত্ব ঠিক করার বিধানে অবশ্যই আমাদের একমত হতে হবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, সংসদে ১০০ নারী আসন সংরক্ষিত থাকবে। পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে যে দল নিম্ন কক্ষে যত শতাংশ ভোট পাবে, সে দল সে পরিমাণ নারী আসনে প্রতিনিধি দিতে পারবে। আমরা নিম্ন ও উচ্চ উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন চাই। বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।