সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় উদ্বেগ, কোরবানির ঈদ এলেই আশঙ্কা বাড়ে
বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে পর পর দুই দিন গোলাগুলির ঘটনায় সীমান্তে নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। রোববার রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হন।
প্রথম নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে পর পর দুই দিন গোলাগুলির ঘটনায় সীমান্তে নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। রোববার রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হন। অভিযোগ উঠেছে, ওইদিন রাতে ওই যুবকসহ পাটগ্রামের সাত-আটজন ব্যক্তি কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকের সাথে মিলে সীমান্তে গরু পাচারের চেষ্টা করছিলেন।
এ সময় বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে ওই যুবক গুলিবিদ্ধ হন এবং বাকিরা পালিয়ে যান। গুলিবিদ্ধ লাশটি কাঁটাতার থেকে দুই শ’ গজ ভেতরে পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় গ্রামবাসী। পরে মেখলিগঞ্জ থানা পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। পরদিন মঙ্গলবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশী কৃষক আহত হন।
বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী- বিজিবি’র ৬০ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক আশিক হাসান উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে জানান, সকালে ওই দুই কৃষক সীমান্ত ঘেঁষে বাংলাদেশের অংশে গরু চড়াচ্ছিলেন। এসময় বিএসএফের টহল দল আচমকা তাদের ওপর ছররা গুলি ছোঁড়ে। এতে দুই কৃষকের একজন হাতে এবং অপরজন মুখের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। পরে স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। এ ঘটনাকে ঘিরে বিকেলে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অধিনায়ক পর্যায়ের একটি পতাকা বৈঠক হয়। সেখানে বিজিবির পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষিদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে। বিজিবি এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে দোষিদের নিজস্ব আইনে বিচারের আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান আশিক হাসান উল্লাহ। সাধারণ কোরবানির ঈদের কয়েক মাস আগে থেকে সীমান্তে গরু পাচারের হার বেড়ে যায়, এ কারণে সহিংসতার আশঙ্কাও বাড়ে। তাই বছরের এই সময়ে সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্টে বিজিবির পক্ষ থেকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয় বলে তিনি জানান।
‘কোরবানির ঈদের আগে গরু পাচারের প্রবণতা বেশি থাকে। তাই সীমান্তের যেসব পয়েন্টে গরু পাচারের আশঙ্কা রয়েছে আমরা সেই অংশে ইতোমধ্যে নজরদারি বাড়িয়েছি। এ ব্যাপারে বিএসএফ-কে অবহিত করা হয়েছে। আমরা পাচার প্রতিরোধে ঈদের দুই এক মাস আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে যাই যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যায়,’ তিনি বলেন। আইন ও শালিস কেন্দ্রের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বিএসএফের গুলিতে নয়জন নিহত হয়েছেন। আগের বছরের পাঁচ মাসে এই সংখ্যা ছিল চারজন। সীমান্তে এই সময়ে আহত হয়েছেন ১০ জন যা গতবছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।
সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সম্মত হলেও সীমান্তে সহিংসতা থামেনি বরং বেড়েছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় সম্মেলনে একটি অন্যতম অ্যাজেন্ডা থাকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি। বিএসএফের গুলিতে আলোচিত ফেলানী হত্যার পর বাংলাদেশের দাবির মুখে ২০১৪ সালে দিল্লিতে বিএসএফ ও বিজিবির মহাপরিচালকদের বৈঠকের পর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে একটি সমঝোতায় আসে।
সীমান্তে অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে ২০১৮ সালের এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। পরের বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে বিএসএফের ডিজি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থে সীমান্তরক্ষীদের গুলি চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেটাও আহত করার উদ্দেশ্যে, হত্যার উদ্দেশ্যে নয়।
এ ব্যাপারে বিজিবি’র ৬০ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক আশিক হাসান উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে জানান, ‘রুল অব এনগেজমেন্টে বলা আছে, যদি আত্মরক্ষার প্রয়োজন হয় তাহলে প্রথমে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হবে। যদি এতে হামলাকারী নিবৃত না হয় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে গুলি ছোড়া যাবে, তবে সেটা অবশ্যই হাঁটুর নিচের অংশে হতে হবে।’
এক্ষেত্রে বিএসএফ যে গোলাগুলি করেছে তার কোনো ক্ষেত্রে তারা প্রমাণ করতে পারেনি যে হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের দ্বারা তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, নিহতরা সবসময়ই নিরস্ত্র ছিলেন।
দু'দেশেরই আইন অনুযায়ী, কেউ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করলে, কাঁটাতার কাটলে বা পাচারের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেফতার করে ওই দেশের আইনানুযায়ী বিচার করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোড়া বা নির্যাতন করা যাবে না। এজন্য সীমান্ত প্রহরায় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার বন্ধে দুই দেশ সম্মত হলেও বিএসএফ তা মানছে না বলে অভিযোগ মানবাধিকার কর্মীদের।
সুতরাং বিএসএফ যে প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি লঙ্ঘন করেছে তা স্পষ্ট। কূটনৈতিক দুর্বলতা, জবাবদিহিতার বাইরে বিএসএফ এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতাকে দুষছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তার মতে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতের এমন সহিংস হতে পারে। কিন্তু নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও চীনের সাথে সীমান্তে এমন হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা বিরল।
‘সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য এবং বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য প্রতিবেশী ভারতের ওপর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরণের চাপ দেয়া দরকার, তারা তা দিতে পারছে না। কিংবা হত্যা-নির্যাতন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এই দুর্বলতার কারণেই বাংলাদেশকে খেসারত দিতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন।
বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত হত্যা নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, বিএসএফ তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা না করে বা কোনো সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, হতাহত বাংলাদেশীদের কারো কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি। হত্যার শিকার ব্যক্তিরা নিরস্ত্র ছিলেন। তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। অনেক সময় তারা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য গুলি চালায়। আবার ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যেতে বলে তাদের পেছন থেকে গুলি চালানোর বিষয়েও জানতে পেরেছে মানবাধিকার সংস্থাটি। সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের ওপর বেআইনিভাবে গুলি চালানোর বিষয়টিতে শুরু থেকেই ভারত সরকারের দায়সারা মনোভাব স্পষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
এ ব্যাপারে, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের চেয়ারম্যান এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ জানিয়েছেন, বিএসএফের সদস্যরা যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে অর্থাৎ যারা কর্মকর্তা তারাও এদের দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না। যার কারণে সীমান্ত হত্যা বেশি ঘটে।
এখনো পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশীকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের তথ্য তারা বাংলাদেশকে দেয়নি। বরং দেশটির সরকার বিএসএফকেও তাদের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীর মতো সকল ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রেখেছে।
বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
নূর খান লিটন বলেন, ‘ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও সীমান্ত হত্যা থামছে না। এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা না করে এখন উচিত হবে জাতিসঙ্ঘের সহায়তা নেয়া। যেহেতু দুই দেশের শীর্ষ নেতারাও কোন সুরাহা করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তা ছাড়া সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ মধ্যস্থতা করতে পারে।’
এই দুই দেশের সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনার সূত্রপাত হয় মূলত তিনটি কারণকে ঘিরে- গরু পাচার, অবৈধ অনুপ্রবেশ ও সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলা। মূলত এসব অভিযোগ তুলেই বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালানোর কথা জানিয়ে আসছে বিএসএফ। এক্ষেত্রে, অরক্ষিত সীমানাগুলোয় কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করা সেইসাথে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং সীমান্তে পাচার নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে হত্যা- নির্যাতনের ঘটনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএসএফ কখনো সীমান্তের শূন্য রেখায়, কখনো নিজেদের সীমান্তের ভেতরে, এমনকি বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরেও গুলি ছোড়ে। ভারতের এই আচরণ আইনগত ও মানবিক দিক থেকে অচল বলে মনে করেন নূর খান।
কারণ কী
সীমান্তে হত্যা-নির্যাতনের পেছনে কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমদ। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেন, গোলাগুলি শুধুমাত্র ভারতের অংশ থেকে হয়। বাংলাদেশ কোনো ভারতীয়কে গুলি করে না।
তার মতে, বিএসএফে যারা কাজ করে তারা সাধারণত নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থান করে। যার কারণে তারা মানসিকভাবে সুখী থাকে না। এ কারণেই তারা ‘ট্রিগার হ্যাপি’ হয়ে যায়। মানসিকভাবে চাপের মুখে থাকে বলেই এ অবস্থা হয় বলে তিনি মনে করেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিএসএফ'র হাতে যারা প্রাণ হারাচ্ছে এদের বেশিরভাগই সীমান্ত পার হয়ে গিয়ে গরু বা অন্যান্য ব্যবসা সামগ্রী নিয়ে আসতে গিয়ে হামলার শিকার হয়। তার মতে, এখানে ভাগাভাগির বিষয় থাকতে পারে। যদি তাদের খুশি করা যায় তাহলে তারা গোলাগুলি করে না। এর ব্যতিক্রম হলে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সূত্র : বিবিসি