ব্যাংক খাত: বছরজুড়ে ডলার সংকট, খেলাপি ঋণে রেকর্ড

নানান নাটকীয়তা আর আইএমএফের শর্তে বেরিয়ে আসে রিজার্ভ গণনায় হিসাবের গড়মিল। এসবের মধ্যেই খোলাবাজারে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে ডলারের দর ওঠে ১২৯ টাকায়।

ব্যাংক খাত: বছরজুড়ে ডলার সংকট, খেলাপি ঋণে রেকর্ড

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বছরজুড়ে এক ধরনের ছন্দপতনের মধ্যে ছিল দেশের ব্যাংক খাত। ডলার সংকটের মধ্যেই সমালোচকদের খোরাক জোগায় প্রকৃত রিজার্ভের হিসাবের গণনা। নানান নাটকীয়তা আর আইএমএফের শর্তে বেরিয়ে আসে রিজার্ভ গণনায় হিসাবের গড়মিল। এসবের মধ্যেই খোলাবাজারে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে ডলারের দর ওঠে ১২৯ টাকায়।

ডলার বাজারের এই অস্থিরতার সুযোগ নেয় দেশি-বিদেশি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ১০ ব্যাংক। ডলার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ে এসব ব্যাংক। পাশাপাশি রাজনৈতিক চাপে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণে হয় নতুন রেকর্ড। এসব নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় আসে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ একটি কোম্পানিকে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার বিষয়। এত কিছুর মধ্যে কিছু ভালো পদক্ষেপও ছিল ব্যাংক খাতে। ‘স্মার্ট পদ্ধতিতে’ সুদহার, একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনাসহ কয়েকটি ভালো পদক্ষেপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

বছরজুড়েই ছিল অর্থ সংকট। কমতে থাকে রিজার্ভ, উদ্বেগ তৈরি করে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এতকিছুর মধ্যেও কিছুটা আশা জাগায় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া। সারাবছরই আলোচনায় ছিল আইএমএফের ঋণ। নানান নাটকীয়তার পরে এরই মধ্যে ঋণের দুই কিস্তি দিয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি এডিবির ঋণে কিছুটা বেড়েছে রিজার্ভ।

সবশেষ আলোচনায় আসে টাকার সংকটে পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হওয়ার বিষয়। চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক থাকায় এসব ব্যাংককে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে অর্থ সমন্বয়ের সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে পরে চিঠি পাঠানোর বিষয় স্বীকার করেও লেনদেন বন্ধের হুঁশিয়ারির বিষয় অস্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে ওএসডি ভীতি তৈরি হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ে।

বছরজুড়েই ছিল অর্থ সংকট। কমতে থাকে রিজার্ভ, উদ্বেগ তৈরি করে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এত কিছুর মধ্যেও কিছুটা আশা জাগায় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া। সারাবছরই আলোচনায় ছিল আইএমএফের ঋণ। নানান নাটকীয়তার পরে এরই মধ্যে ঋণের দুই কিস্তি দিয়েছে আইএমএফ।

বছর শেষে সবার এটাই প্রত্যাশা, ভীতি, রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এবং ডলার সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক লেনদেন ফিরে আসুক ব্যাংক খাতে।

সিআইবির নিয়ন্ত্রণ ছাড়লো কেন্দ্রীয় ব্যাংক: ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভাগ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি। এটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা ছাড়া আর কেউ এ বিভাগের কোনো বিষয় পর্যবেক্ষণ বা তথ্য পেতেন না। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখা এতদিন এ বিষয়ে তথ্য নিতে পারতো। এখন থেকে ব্যাংকগুলোর শাখা অফিসও সিআইবি তথ্য পরিদর্শন ও পরিবর্তন করতে পারবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এতে ব্যাংকারদের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি হবে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

সর্বোচ্চ দরে ডলার বিক্রির রেকর্ড: বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট চলছে দীর্ঘদিন। এমনকি ডলারের দর নিয়ে কারসাজি করে ১০ ব্যাংক। নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির দায়ে জরিমানার মুখে পড়ে একাধিক ব্যাংক। শাস্তি হয় ছয় ব্যাংকের এমডির। সরিয়ে দেওয়া হয় এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের। এমন অস্থিরতায় খোলাবাজারে ডলারের দাম ওঠে ১২৭ টাকায়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দর। এছাড়া নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে ডলার বিক্রি করায় সতি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত ও ১০টিকে শোকজ করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় একাধিক প্রতিষ্ঠানকে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট চলছে দীর্ঘদিন। এমনকি ডলারের দর নিয়ে কারসাজি করে ১০ ব্যাংক। নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির দায়ে জরিমানার মুখে পড়ে একাধিক ব্যাংক। শাস্তি হয় ছয় ব্যাংকের এমডির। সরিয়ে দেওয়া হয় এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের।

নগদ ডলার ব্যাংকে আনতে পদক্ষেপ: ডলার সংকটের সমাধানে নেওয়া হয় নানান পদক্ষেপ, তবে কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। ডলারের দর বেঁধে দেওয়ার কাজটিও ব্যাংকের ওপরে ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও সংকট কাটে না, খোলাবাজারে নগদ ডলারের প্রবাহ থেকেই যায়। ভিন্ন পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমবারের মতো ডলারের দাম তিন ধাপে কমানো হয়। এতে টাকার বিপরীতে ডলারের অবমূল্যায়ন করা হয় কৌশলে। এখন রেমিট্যান্স হিসেবে আসা ডলারপ্রতি গ্রাহক পান ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা।

ঋণ নিয়ে আইএমএফের শর্ত: বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিতে নানান শর্ত বেঁধে দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। শর্ত পূরণের আলোকেই ২ ফেব্রুয়ারি আসে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এরপর দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পেতে আরও শর্ত জুড়ে দেয় সংস্থাটি। একের পর এক পরিদর্শন, পরামর্শ টিম পাঠানো হয়। ঋণ না পাওয়ার উপক্রমও তৈরি হয়। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব খাতের শর্ত ছাড়া বাকি সব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ। এরপর নানান নাটকীয়তা শেষে চলতি ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার আসে দেশে।

একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক কমিয়ে আনা: একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এর সংশোধনী অনুযায়ী একটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে একই পরিবারের সর্বোচ্চ চারজন সদস্য থাকতে পারতেন। ২০১৮ সালে করা এই আইনে পরিবর্তন আনা হয় চলতি বছরের ২১ জুন। জাতীয় সংসদে পাস হওয়া নতুন আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকে এক পরিবারের তিনজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না।

চলতি বছর খেলাপি ঋণের রেকর্ড তৈরি হয় দেশের ব্যাংক খাতে। জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এসময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।

‘স্মার্ট পদ্ধতিতে’ নির্ধারণ হবে সুদহার: আইএমএফের শর্ত ও ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে ৯ শতাংশ সুদহার তুলে ঋণের সুদহারে ‘স্মার্ট পদ্ধতি’ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন এ পদ্ধতি কার্যকর হয় চলতি বছরের জুলাই থেকে। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দিয়ে ট্রেজারি বিল, বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার (ওয়েটেড) বিবেচনা করে প্রতি মাসে একটি রেফারেন্স রেট নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংক।

পুরো ঋণ পরিশোধ করলো শ্রীলঙ্কা: দুই বছর আগে মুদ্রাবিনিময় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলার ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে তিন কিস্তিতে এই ঋণ দেয় বাংলাদেশ। ওই বছরের ১৯ আগস্ট প্রথম কিস্তিতে ৫০ মিলিয়ন ডলার, ১১ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তিতে ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং সেপ্টেম্বরে ৫০ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়। কোনো দেশকে দেওয়া বাংলাদেশের প্রথম ঋণ এটি। চলতি বছর ওই ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা।

খেলাপি ঋণে রেকর্ড: চলতি বছর খেলাপি ঋণের রেকর্ড তৈরি হয় দেশের ব্যাংক খাতে। জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এসময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।

রিজার্ভ নিয়ে লুকোচুরি: আইএমএফের গণনা পদ্ধতিতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ১৩ জুলাই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হিসাবে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের তারতম্য ছিল। ১৩ জুলাই আইএমএফের গণনা পদ্ধতিতে দেশের রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ওইদিন রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার।

আর্থিক হিসাবে ঘাটতির রেকর্ড: চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ সূচকে ১২৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবের সূচকে এক হাজার ৫৪৬ কোটি ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল।

পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম: শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক। বারবার অবহিত করার পরও ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি হিসাবের ঋণাত্মক স্থিতি সমন্বয়ের জন্য ২০ কর্মদিবসের সময় বেঁধে দেয়। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। গত ২৮ নভেম্বর ব্যাংক পাঁচটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রিজার্ভ কিছুটা বাড়লো: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪০ কোটি ডলার ঋণের ওপর ভর করে দেশের রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। এই দুই সংস্থার ঋণ পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে। তবে খরচ করার মতো রিজার্ভ (বিপিএম৬) আছে ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। যদিও আসছে বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আকু (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) পেমেন্ট রয়েছে। সেখানে এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করতে হবে।