গুলিতে প্রাণ গেল হাবিবের সন্তানদের নিয়ে দিশাহারা স্ত্রী

গত ২০শে জুলাই তার পরিবারের সদস্যদের সব আনন্দ রূপ নেয় বিষাদে। ওইদিন ঢাকায় চলছিল আন্দোলনকারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ।

গুলিতে প্রাণ গেল হাবিবের সন্তানদের নিয়ে দিশাহারা স্ত্রী

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: ভোলার লালমোহন উপজেলার ৪০ বছর বয়সী মো. হাবিব। ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের চরমোল্লাজী এলাকার কাদের মৌলভী বাড়ির মৃত শফিউল্যাহর ৫ সন্তানের মধ্যে সবার বড়। খুব ছোটবেলায় তার বাবা মারা যান। এরপর তার মা সন্তানদের নিয়ে জীবিকার তাগিদে চলে যান ঢাকায়। সেখানে তিনি একটি কারখানায় কাজ করে বড় করে তোলেন হাবিবসহ অন্যান্য সন্তানদের। কিছুটা বড় হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় হাবিবের জীবন সংগ্রাম। বেছে নেন ড্রাইভিং পেশা। কখনো সিএনজি আবার কখনো প্রাইভেটকার ভাড়া নিয়ে চালাতেন। ২৪ বছর আগে বিয়ে করেন হাবিব। তার ৩ কন্যা সন্তান এবং এক পুত্র সন্তান রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতেন ঢাকার শনির আখড়ার ধনিয়া পাটেরবাগ এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। সুন্দরভাবেই চলছিল হাবিবের সংসার।

গত ২০শে জুলাই তার পরিবারের সদস্যদের সব আনন্দ রূপ নেয় বিষাদে। ওইদিন ঢাকায় চলছিল আন্দোলনকারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ। তবুও জীবিকার তাগিদে বের হন গ্যারেজে রাখা সিএনজি বের করতে। গ্যারেজে যাওয়ার আগেই হঠাৎ করে গুলিবিদ্ধ হন হাবিব। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে তাকে দুই পথচারী নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। খবর পেয়ে হাবিবের নিথর দেহ দেখতে ছুটে যান ছেলে-মেয়ে এবং ছোট ভাইসহ স্বজনরা। তাদের সেখানে পৌঁছানোর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় লাশ শনাক্ত করতে। এরপর তারা খোঁজা শুরু করেন লাশ। একপর্যায়ে খোঁজ মেলে হাবিবের প্রাণহীন দেহের। ময়নাতদন্ত শেষে ওই লাশ স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হয় ২১শে জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে। এরইমধ্যে নরম হয়ে যায় হাবিবের মরদেহ। যার জন্য আর হাবিবের মরদেহ গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের চরমোল্লাজীতে নেয়া সম্ভব হয়নি। স্বজনরা বাধ্য হয়ে জুরাইন কবরস্থানে হাবিবের লাশ দাফন করেন। 

বর্তমানে চরম বিপাকে তার স্ত্রী-সন্তানরা। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন হাবিব। তার অনুপস্থিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন হাবিবের স্ত্রী মোসা. আয়েশা বেগম। সন্তানদের মধ্যে সবার বড় মেয়ে। সে ইন্টারমেডিয়েটে পড়ালেখা করে। এরপরই ছেলে মো. রিয়াদ। তার বয়স ১৫ বা ১৬। সংসার চালাতে বাবাকে সাহায্য করতে স্থানীয় একটি সুইস কারখানায় চাকরি নেন রিয়াদ। এ ছাড়া তিন বছর ও এক বছর বয়সী আরও দুই মেয়ে বাসায় মায়ের সঙ্গেই থাকে। এদের ভবিষ্যতের চিন্তায় দিশাহারা হাবিবের স্ত্রী আয়েশা বেগম। মুঠোফোনে হাবিবের স্ত্রী বলেন, আমার স্বামীর তো কোনো দোষ ছিল না, তাহলে কেন আমার নিরীহ স্বামীকে মারা হলো? স্বামী তো এখন আর দুনিয়াতে নেই। দাবি করেও আর স্বামীকে ফিরে পাবো না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে কোনো সহযোগিতা করা হয় তাহলে খুবই উপকার হবে।

মুঠোফোনে প্রতিবেদককে নিহত হাবিবের ছোটভাই মো. নূরউদ্দিন জানান, ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে যাই। ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ গ্রহণ করি। আমার ভাই হাবিবের হৃদপিণ্ড ও কোমরে দুইটি গুলি লেগেছে। লাশ গ্রহণের পর থেকে দাফন পর্যন্ত আমি উপস্থিত ছিলাম। ভাইকে দাফন করে রেখে এসেছি। তবে তার স্ত্রী-সন্তানদের এখন কী হবে? আমার ভাইয়ের বিবাহ উপযুক্ত একজন মেয়ে আছে। এ ছাড়া ছোট আরও দুই মেয়েসহ একজন ছেলেও আছে। আমার ভাই-ই ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। এখন তিনি নেই। তার পরিবারের সদস্যদের কী হবে? ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে তার স্ত্রী-সন্তানদের আমার সাধ্যের মধ্যে সহযোগিতা করছি। এভাবে আর কতোদিন সহযোগিতা করতে পারবো। আমি নিজেও তেমন সচ্ছল না। তাই সরকারের কাছে আমার অনুরোধ; আমার মৃত ভাইয়ের সন্তানদের কথা মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করে যেন আর্থিকভাবে তাদের সহযোগিতা করা হয়।

তিনি আরও জানান, ছোট বেলায় আমরা মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসার পর তেমন আর এলাকায় যাওয়া হয়নি। এই সুযোগে গ্রামে থাকা চাচারা আমাদের জমি তাদের নামে করিয়ে নিয়েছেন। যার জন্য গ্রামে আর আমাদের নিজস্ব কোনো জমি বা সম্পত্তি কিছুই নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমরা ঢাকায় ভাড়া বাসায়ই থাকছি। আমার মৃত ভাই হাবিবের স্ত্রী-সন্তানদেরও এখন বাধ্য হয়ে ঢাকাতেই থাকতে হবে। 
এ ব্যাপারে লালমোহন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মাহবুব উল আলম বলেন, ঢাকার আন্দোলনে লালমোহন উপজেলার মোট ৭ জন নিহত হয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা তাদের তথ্য সংগ্রহ করেছি।