রংপুরে এমটিএফই’র ফাঁদে নিঃস্ব ৪০০ নারী-পুরুষ
মাত্র ৬১ হাজার টাকা বিনিয়োগে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা করে লাভ পাবার আশায় গুড়েবালি পড়েছে।
প্রথম নিউজ, রংপুর: কেউ বিক্রি করেছেন শখের মোটরসাইকেল, কেউ নিয়েছেন ব্যাংক থেকে ঋণ। কেউ আবার রেখেছেন জমি বন্দক, নয়তো করেছেন গরু-ছাগল বিক্রি। এমন চার শতাধিকের বেশি অসহায় নারী-পুরুষ লাভের আশায় বিনিয়োগ করেছেন এমটিএফইতে। এখন সুদ-আসল কোনোটাই ফেরত না পেয়ে নিঃস্ব তারা। হঠাৎ এমন প্রতারণার শিকার হয়ে কেউ হয়েছেন অসুস্থ, কারো চলে গেছে ঘরের বউ। এর নেপথ্যে প্রগতি নামের একটি গ্রামীণ সমিতির কর্মীরা ইন্ধন দিয়েছে। আর এ সুযোগে প্রতারণার ফাঁদ পেতে প্রায় তিন কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা এমটিএফই। এই ঘটনার শিকার রংপুরের পীরগাছা উপজেলার চার শতাধিক খেটে খাওয়া মানুষ।
সম্প্রতি উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের নেক মামুদ এলাকা গেলে প্রতারণার শিকার হওয়া নারী-পুরুষেরা বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। মাত্র ৬১ হাজার টাকা বিনিয়োগে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা করে লাভ পাবার আশায় গুড়েবালি পড়েছে। এমটিএফই’র প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা। হোসনে আরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এমটিএফইতে ৬১ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। স্বামী দিনমজুর, ছেলে-মেয়ে পাঁচজন। সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে এমন উদ্যোগ নেওয়াই কাল হলো তার। জানেন না এখন কি করবেন তিনি। মেনে নেবেন কি তার স্বামী।
কাঁদতে কাঁদতে হোসনে আরা বলেন, আমাকে তো অনেকভাবে বোঝানো হয়েছে। আমি অন্যদেরও দেখলাম সেখানে টাকা দিতে। এজন্য কষ্ট হলেও এমটিএফইতে মোটা অংকের টাকা জমা করেছি। এখন তারা নাকি অফিস বন্ধ করে চলে গেছে। আমি গরিব মানুষ, কিভাবে কি করব ভেবে পাচ্ছি না। অপরদিকে ভ্যান চালক সুরুজ জামান। পঁচিশ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইনভেস্ট করেছেন এমটিএফইতে। সুদ-আসল কোনোটাই না পাওয়ায় ছেড়ে চলে গেছেন তার নতুন বউ। এ কারণে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এই যুবক। সুরুজ জামান বলেন, আমার বোনের স্বামীর হাতে টাকা দিয়েছি। আমার টাকার দায়িত্ব সে নিজে নিয়েছে। এখন শুনতেছি এমটিএফই’র লোকেরা নাকি পালিয়ে গেছে। আমার টাকার বিষয়ে কেউ কিছু বলছেও না। আমি এখন কি করব? এতগুলো ঋণ করে টাকা দিলাম সেই টাকার কি হবে? আমি আমার টাকা ফেরত চাই।
একই গল্প আনোয়ারুল, নজরুল, রতন, স্বপন, শেফালীসহ নেক মামুদ এলাকাসহ উপজেলার চার শতাধিকের বেশি মানুষের। তারা বলছেন, ডলারের প্রলোভন দেখিয়ে প্রগতি সমিতির আমিনুল, সুজা, হজরত আলী ও সিরাজুলরা ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে ইন্টারনেটে (অনলাইনে) টাকা ইনভেস্ট করিয়েছে। এমএলএম কোম্পানি প্রতারণায় এমটিএফই’র সর্বস্বান্ত মানুষগুলো এখন দিশেহারা। স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামের মানুষ এমটিএফই সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। প্রগতি সমিতির কর্মীরা তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়েছে। একেক জনের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা, উর্ধ্বে পাঁচ-ছয় লাখ টাকাও নিয়েছে। বর্তমানে অফিসে তালা ঝুলিয়ে পলাতক প্রগতির কর্মীরা।
মাত্র ৬১ হাজার টাকা বিনিয়োগে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা আয়ের স্বপ্নে এমটিএফই-তে লক্ষাধিকের বেশি টাকা জমা করেছেন এক স্কুলশিক্ষক। প্রতারণার শিকার ওই শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, আমি তো জানতাম যত বেশি বিনিয়োগ তত বেশি লাভ। কোনো ধরণের কাজ না করে ঘরে বসেই প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করা যাবে অ্যাপের মাধ্যমে। অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকে শুরু হবে টাকা পাওয়া। এমনই লোভনীয় কথার ফাঁদে ফেলে সারাদেশের মতো পীরগাছা উপজেলার তিন-চারশ গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত তিন কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে মাল্টিন্যাশনাল ক্রেডিট এমএলএম কোম্পানি এমটিএফই।
সোহেল রানা নামে এক যুবক জানালেন, গ্রামের সাদাসিদে মানুষকে টার্গেট করেছিল প্রগতি সমিতির কর্মীরা। তারা অল্প বিনিয়োগে বেশি লাভের গল্প শুনিয়েছে। খেটে খাওয়া দিনমজুর, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নতুন উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের ফাঁদে পড়ে। এক ডলারে ১২০ টাকার বেশি মিলবে, আবার ৩০ হাজার টাকা জমা করলে তিন লাখ টাকা দেওয়া হবে এমন কথাও বলেছেন প্রতারকরা। অফিসে জাকজমক অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার আর নিত্যনতুন অফারে আকৃষ্ট হতে গ্রামের লোকেরা বিনিয়োগ করেছে। সবমিলিয়ে অন্তত তিন কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে এমটিএফই।
এদিকে প্রগতি সমিতির সদস্য অভিযুক্ত সিরাজুল ইসলামকে খুঁজে পাওয়া গেলেও প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। দোষ চাপান সমিতির সিও আমিনুলসহ আরও দুজনের ওপর। ঢাকা পোস্টকে সিরাজুল বলেন, আমার মাধ্যমে কোনো লেনদেন হয়নি। এখানে মূল ব্যক্তি তিনজন সিইও আমিনুল, কামিং সিইও সুজা আর হযরত আলী। এরাই টাকা নেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু করেছে। আমরা সেমিনারের মাধ্যমে এমটিএফই সম্পর্কে জানতে পারি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পীরগাছাসহ সারাদেশ থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে মাল্টিন্যাশনাল ক্রেডিট এমএলএম কোম্পানি এমটিএফই। বিদেশি এই কোম্পানির নেই কোনো ধরনের সরকারি অনুমোদন। বাংলাদেশে নেই কোনো হেড অফিস। তারপরও এদের এজেন্ট হয়ে কাজ করে ১৫০ সদস্য তৈরি করে দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ দেখালেই হওয়া যায় কোম্পানীর সিইও। এই সিইও’র রয়েছে আবার কোম্পানি থেকে মোটা অংকের বোনাস।
মূলত একজন সিইও’র মাধ্যমেই গ্রাহকের আইডি খোলা ও লেনদেন করা হয়। কিছুদিন থেকে পীরগাছা উপজেলায় অফিস খুলে চলছিল এই প্রতারণার কাজ। প্রতিষ্ঠানটি সিইও পদে আমিনুল ইসলামসহ তার সঙ্গীরা গ্রামের বেকার লোকজনদের বিভিন্ন ভাবে লোভ দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তিন থেকে চারশ জনকে অ্যাপসে অ্যাকাউন্ড খুলে কোম্পানীর সদস্য করে নেন। প্রতি সদস্যের কাছ থেকে ৬১ হাজার থেকে শুরু করে ছয় লক্ষ টাকা পর্যন্ত নেন তারা। কিছু টাকা গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে বোনাস দেখিয়ে সব টাকা নিজেদের কাছে জমা নেয় চক্রটি। হঠাৎ কোম্পানিটি অ্যাপসের উন্নয়নের কাজ করার কথা বলে সব ধরনের টাকা উত্তোলন বন্ধ রাখে। ১৮ আগস্ট থেকে উধাও হয় অ্যাপসটি।
এদিকে শুধু এমটিএফই নয়, এসপিজি ও কাটলিসহ নানা অ্যাপস- এ টাকা ইনভেস্ট করে প্রতারিত হয়েছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এই অ্যাপসগুলোর এডমিনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তাদের। অন্যদিকে প্রতারণা এড়াতে অনলাইনে বুঝে শুনে টাকা বিনিয়োগের পরামর্শ আইটি বিশেষজ্ঞদের। ইনবক্স আইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবু সায়েম বলছেন, ইন্টারনেটে টাকা আয় করতে কোন ইনভেস্ট প্রয়োজন নেই। না বুঝে কোনো অ্যাপস এ টাকা ইনভেস্ট করলে প্রতারণার শিকার হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা এ ধরনের কোম্পানির প্রলোভনে পড়েছেন, তারা না বুঝে টাকা বিনিয়োগ করছে। আসলে আমাদের বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানির মূল কাজ বা ফোকাসটা বোঝা উচিত। যদি ভেবে চিন্তে কাজ বুঝে কেউ বিনিয়োগ করেন, তাহলে প্রতারণার শিকার হবার সুযোগ কম থাকবে। শুধু তাই নয় জেনে বুঝে বিনিয়োগ ভবিষ্যতের জন্য ভালো।
পীরগাছা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুমুর রহমান বলেন, প্রতারণার শিকার হয়েছে এমন কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। তবে এমন অভিযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।