স্বামীকে ৭ মাস থানায় আটকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে ওসি প্রদীপ: আদালতে গৃহবধূ ছেনুয়ারা 

স্বামীকে ৭ মাস থানায় আটকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে ওসি প্রদীপ: আদালতে গৃহবধূ ছেনুয়ারা 

স্বামীকে ৭ মাস থানায় আটকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে ওসি প্রদীপ: আদালতে গৃহবধূ ছেনুয়ারা 

প্রথম নিউজ, কক্সবাজার: সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার চতুর্থ দফায় প্রথম দিনে ১৫তম সাক্ষী ছেনুয়ারা বেগম আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলেছেন, ‘টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ তার স্বামী আব্দুল জলিলকে থানার দ্বিতীয় তলায় একটি টর্চার রুমে আটকে রেখে সাত মাস নির্যাতন চালান। পরে ওসি প্রদীপ তার দুই কনস্টেবল সাগর দেব ও রুবেল শর্মাকে দিয়ে আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। এই টাকা দেওয়ার পরও ওসি প্রদীপ আমার স্বামীকে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করে’।

ছেনুয়ারা বেগম তার সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আদালতের কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান সাবেক ওসি প্রদীপকে আঙুল দিয়ে দেখান। এ সময় ওসি প্রদীপকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। ছেনুয়ারা বেগম আদালতে ওসি প্রদীপের নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আদালতে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

আদালতে অপর সাক্ষী টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য হাম জালালও তার ওপর ওসি প্রদীপের নানা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দেন। আদালতে এই দুজন ছাড়াও আলী আকবর নামে আর এক ব্যক্তি সাক্ষ্য দেন।

এ নিয়ে মঙ্গলবার সিনহা হত্যা মামলার তিন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে সাক্ষী হাম জালালকে ওসি প্রদীপসহ তিন আসামির আইনজীবী জেরা সম্পন্ন করতে পারেননি। বুধবার তারা জেরা সম্পন্ন করবেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম এবং বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর মঙ্গলবার সিনহা হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের চতুর্থ পর্যায়ের প্রথম দিন আদালতের কার্যক্রম শেষে সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে এ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

অপর দিকে ওসি প্রদীপের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সিনহা মামলাকে অতি দ্রুত শেষ করতে গিয়ে আসামিদের ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এর আগে গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত মামলার প্রথম দফার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এতে সাক্ষ্য দেন মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস এবং ২ নম্বর সাক্ষী ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে একই গাড়িতে থাকা সঙ্গী সাহেদুল সিফাত। পরে দ্বিতীয় দফায় চার দিনে চার প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তৃতীয় দফায় তিন দিনে আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে ওসি প্রদীপসহ মামলার ১৫ আসামিকে প্রিজন ভ্যানে করে কড়া পুলিশ পাহারায় আদালতে আনা হয়।

পিপি ফরিদুল বলেন, মামলায় সাক্ষ্যদানের জন্য ৮৩  সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ২৯ জনকে আদালত নোটিশ দিয়েছিলেন। গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে মামলার বাদী ও ২ নম্বর সাক্ষী জবানবন্দি প্রদান করেন। মামলায় দ্বিতীয় দফায় চার দিনে চার প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তৃতীয় দফায় তিন দিনে সাক্ষ্য নেয়া হয় সিনহার মৃতদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকসহ আট প্রত্যক্ষদর্শীর।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় থেকে ১৫তম সাক্ষী হিসেবে টেকনাফের হ্নীলার বাসিন্দা গৃহবধূ ছেনুয়ারা বেগমের জবানবন্দি গ্রহণের মধ্য দিয়ে চতুর্থ দফায় প্রথম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানায় কর্মরত থাকাকালীন তার ( ছেনুয়ারা ) স্বামীকে তুলে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত দেখানো হয়।

গত বছর ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

এ ঘটনায় গত বছর ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া (তদন্ত) সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় লিয়াকত আলীকে। আদালত মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় র‌্যাবকে। ঘটনার ছয় দিন পর ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতসহ সাত পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি এবং রামু থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন।

পরে র‌্যাব পুলিশের দায়ের মামলার ৩ সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় টেকনাফ থানা পুলিশের সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে। সর্বশেষ গত ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেব।

গত বছর ১৩ ডিসেম্বর র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের তৎকালীন দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।

গত ২৭ জুন আদালত ১৫ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এতে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে।