শিশুবান্ধব পরিবেশে আদালত সাজাতে এজলাস ছেড়ে নেমে এলেন বিচারক
প্রথম নিউজ, নওগাঁ: লালসালু ঘেরা প্রচলিত এজলাসে হয়নি বিচার কার্যক্রম। এদিন শিশু আইন অনুযায়ী শিশুদের জন্য আলাদা এজলাস তৈরি করা হয় আদালতে। সেখানে ছিল না আসামি ও সাক্ষীর কাঠগড়া। বিচারক বসেননি তার জন্য নির্ধারিত প্রচলিত এজলাসের চেয়ারে। সরকারি কৌঁসুলি ও আইনজীবীদের কারও গায়ে ছিল না কোট, গাউন। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের পরণেও ছিল না ইউনিফর্ম।
এজলাসের ভেতর বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলি ছোট ছোট টেবিলে বসেন। সামনে আইনজীবীরা বসেন তাদের নির্ধারিত আসনে। এজলাসের ভেতরে ছিলেন না কোনো পুলিশ সদস্য। প্রথমবারের শিশুবান্ধব পরিবেশে হয় শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম।
আজ বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) নওগাঁর আদালত ভবনের চতুর্থ তলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ ও শিশু আদালত-২ নওগাঁর বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. মেহেদী হাসান তালুকদারের আদালতের সামনে এই চিত্র দেখা গেছে। অন্যদিন বিচারক এজলাসে বসলেও এদিন নেমে আসেন নিচে। আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুদের বসানো হয় বেঞ্চে। এজলাসের নিচে বিচারক চেয়ার-টেবিল বসিয়ে কথা বলেন শিশুদের সঙ্গে।
এছাড়া বাহিনীর পোশাক পরে সাক্ষ্য দিতে আসা তিন পুলিশ সদস্যকেও শিশু আইন অনুযায়ী সেই পোশাক খুলে স্বাভাবিক পোশাকে সাক্ষ্য দিতে হয়েছে, যেন তারা পুলিশ সেটা শিশুরা বুঝতে না পারে। নওগাঁর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এভাবে শিশু আদালত গড়ে তোলায় খুশি শিশুদের পরিবার, আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্টরা। এভাবে প্রত্যেক সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এই ট্রাইব্যুনালে শিশু আদালত বসবে।
জানা গেছে, আগে প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুদের বিচার হতো। ২০২০ সালে আইন সংশোধন করে দেশের সবগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে শিশু আদালত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শিশু আইনের শিশুদের জন্য আদালত কীভাবে গড়ে উঠবে তার বর্ণনাও দেওয়া হয়। কিন্তু এতদিন কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল এ নিয়ম। যথাযথভাবে বড়দের মতো শিশুদের বিচার হতো আদালতে। তবে আজ বৃহস্পতিবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এ প্রথমবারের মতো এ আইনের নিয়ম মেনে শিশু আদালত বসানো হয়। এ উপলক্ষে সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো হয় সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মেহেদী হাসান তালুকদারের এজলাস। যাতে লালসালু মোড়ানো এজলাস শিশুরা দেখতে না পায়। একইরকম পর্দা দিয়ে বেঞ্চ সহকারী, সাক্ষীদের দাঁড়ানোর মঞ্চ ও কাঠগড়া মোড়ানো হয়।
বিচারক এজলাস ছেড়ে নেমে চেয়ার-টেবিলে বসে পরিচালনা করেন কার্যক্রম। তিনি নিজেই শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন। অর্থাৎ অভিযুক্ত কোনো শিশু বুঝতেই পারেনি তাকে কোনো আদালতে হাজির করা হয়েছে।
শিশু ও স্বজনের বক্তব্য: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি মামলায় শুনানি শেষে এক শিশু আদালতের বারান্দায় যখন আসে তখন তার চোখে সেই বিমর্ষ ভাব আর দেখা যায়নি। নির্ভার তার স্বজনরাও। বিচারাধীন মামলায় এদিন আদালতে হাজির হওয়া শিশু-কিশোরদের সবাইকে দেখা গেছে ভিন্ন চেহারায়।
মাদক মামলার আসামি ওই শিশু আদালতের বারান্দায় বলে, ‘আমি এখন জামিনে আছি। শুনানিকালে বিচারক আমাকে আদরের সঙ্গে বাবা বলে সম্বোধন করে বলেছেন যাতে নতুন করে অপরাধে না জড়াই এবং নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ি। আমি তার কথা রাখার চেষ্টা করবো।’ শিশুটি জানায়, ‘আগে কোর্টে (আদালতে) আসলে ভয় পেতাম। আজকে ভয় লাগেনি। শিশুটির বাবা বলেন, তার ছেলে যতবারই আদালতে এসেছে আতঙ্কের মধ্যে ছিল। এবার তার ছেলে ভয় পায়নি। বরং এই পরিবেশ পেয়ে নিজেকে সংশোধনের জন্য গড়ে তুলবে বলে জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: বদলগাছী থানার একটি মামলায় আজ আদালতে সাক্ষ্য দেন পুলিশের এসআই মো. সেলিম। বর্তমানে তিনি পুলিশ পরিদর্শক (অফিসার ইনচার্জ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভোলাহাট থানায় কর্মরত। তাকেও সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। বিচারক ও আইনজীবীদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি এই মামলার সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষ্য শেষে বেরিয়ে আদালতের বারান্দায় এসআই সেলিম বলেন, ১৩ বছরের চাকরিজীবনে অনেক মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছি। এর মধ্যে শিশু মামলাও ছিল। কিন্তু আজ জীবনে প্রথম অন্যভাবে আদালতে সাক্ষ্য দিলাম। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ ও শিশু আদালত-২ নওগাঁর বেঞ্চ সহকারী ইকবাল হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার ৩৪টি মামলার শুনানি হয়েছে। সপ্তাহের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার শুধু শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম চলবে। যাতে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন খুন, ধর্ষণসহ অন্য মামলার আসামিদের সংস্পর্শে শিশুরা না আসে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ ও শিশু আদালত-২ নওগাঁর বিশেষ পি.পি মো. মকবুল হোসেন বলেন, নওগাঁয় এই প্রথম শিশু আইন অনুযায়ী আলাদাভাবে শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। দাগি অপরাধীদের সঙ্গে শিশুদের বিচারকাজ হচ্ছে না। এতে শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে না। আগামী দিনের কাণ্ডারি এসব শিশু ইতিবাচক চিন্তা করতে পারবে।
তিনি বলেন, শুনানিকালে বিচারক মামলার আসামি প্রতিটি শিশু-কিশোরকে ভবিষ্যতে নতুন করে অপরাধে না জড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন। ভালো হয়ে চলতে কার কী সমস্যা, তা জানার চেষ্টা করেন। প্রয়োজনে শিশুদের অভিভাবকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেন তিনি।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোদাদাদ খান পিটু বলেন, আইন অনুযায়ী নওগাঁয় প্রথম শিশু আদালত সাজানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার শিশুরা বুঝতে পারেনি তাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে বিচারকার্য চলছে। ধীরে ধীরে সব শিশু আদালত এভাবে গড়ে তোলা উচিত। এতে শিশুরা দ্রুত সংশোধনের সুযোগ পাবে।
যা আছে শিশু আইনে: ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৮ সালে আইনটির কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইনে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত বা পৃথক এজলাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তাছাড়া যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের মতো কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।
একই আইনের ১৯(২) ধারায় বলা হয়েছে, শিশু আদালতের আসন বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন সব শিশু বিচার প্রক্রিয়ায় মাতা-পিতা বা তাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ বা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইনজীবীর, যতদূর সম্ভব, সন্নিকটে বসতে পারে। ১৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে, আদালত কক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রয়োজনে, বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করবে।
১৯(৪) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আদালতে বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালতকক্ষে তাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফর্ম পরিধান করতে পারবেন না। জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রবেশন কর্মকর্তা মো. সাজেদুর রহমান বলেন, আলাদা এজলাসে শিশুবান্ধব পরিবেশে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে নওগাঁর একটি শিশু আদালতে। এতে শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।