প্রথম নিউজ, ঢাকা: প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সব সময় খোঁজ রাখতেন যােগ্য লোকদের। তাঁর একটা বরাবরের প্রচেষ্টা ছিলাে উপযুক্ত লোকদের জোগাড় করে কাজে লাগানোর। একবার টেলিভিশনে দেখলাম আমাদের এক অতি পরিচিত বন্ধুর সাক্ষাৎকার। শিপিং সম্বন্ধে বক্তব্য রাখলেন তিনি। আমি তখনও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়িনি। স্বভাবতই কৌতুহল হলো, কিভাবে নজরুল ইসলাম এ সাক্ষাৎকারের সুযােগ পেলেন। শুনলাম একদিন নজরুল ইসলাম সাহেব চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। একই প্লেনে প্রেসিডেন্টও যাত্রী ছিলেন। এফ-২৭ ফকার ফ্রেন্ডশিপ প্লেন। প্লেনের ভেতরে দুই সারিতে দুটি দুটি করে আসন। জি (G) সারিতে প্রেসিডেন্ট বসেছেন। আগের সারি খালি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। নজরুলের সাথে চোখাচোখি হতেই নজরুল সালাম দিলো। স্মিতহাস্যে প্রেসিডেন্ট নজরুলকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। বিস্মিত এবং হতভম্ব নজরুল ধীরপায়ে এগিয়ে এল। প্রেসিডেন্ট পাশের শূন্য আসনে নজরুলকে বসতে বললেন। আগ্রহভরে জানতে চাইলেন নজরুলের কার্যক্ষেত্র ইত্যাদি। পরবর্তী পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার জাপান সফরে নজরুল সফরসঙ্গী নির্বাচিত হলেন এবং এর ফলশ্রুতিতে এ টেলিভিশন সাক্ষাৎকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নজরুল কোনাে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পায়নি। হয়তোবা শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়ার মানদণ্ডে উৎরাতে পারেন নি। এভাবে কতাে লােকের সঙ্গে যে প্রেসিডেন্ট জিয়া যােগাযােগ করেছেন তার কোনাে ইয়ত্তা নেই।
পরবর্তী পর্যায়ে একটা পদ্ধতির মাধ্যমে জিয়া যখন কিছু কাজের লােক পেলেন তাদের মধ্যে কার কি যােগ্যতা আছে তা যাচাই করার জন্যে তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা প্রয়াস খুবই লক্ষণীয় ছিলো। আমার নির্বাচনী এলাকা সীতাকুণ্ড শিল্প প্রধান অঞ্চল। প্রায় চল্লিশ হাজার শ্রমিক এ অঞ্চলে কর্মরত আছে। একদিন বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট ডেকে পাঠালেন। পানি উন্নয়ন বাের্ডে শ্রমিক অসন্তোষ। প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব দিলেন এ সমস্যা পর্যালােচনা করতে। ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কাজী আনওয়ারুল হক সাহেবকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলেন শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ আলােচনায় আমাকে সম্পৃক্ত করতে। বিরাট দায়িত্ব। ওয়াপদা ভবনে যাতায়াত শুরু করলাম। ওয়াপদা কর্তৃপক্ষ এটাকে একটা উটকো ঝামেলা মনে করলেন। বার বার বলা সত্ত্বেও ওয়াপদা ভবনে বসবার জন্যে একটা কক্ষ পেতে দেরি হতে লাগলাে। অবশেষে সদস্য প্রশাসন সাহেবের কক্ষ এবং আসন যেদিন দখল করলাম তার পরের দিনই একটা ছােট্ট কক্ষ পাওয়া গেলাে। যা হােক আপাতত তাই সই। কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করেই মাথা গরম হয়ে গেলাে। বাজে ধরনের কয়েকটা চেয়ার এবং টেবিল দিয়ে ঘরটা ভরে দেয়া হয়েছে। টেলিফোনে সদস্য প্রশাসনকে জিজ্ঞাসা কলাম, এর চাইতে কি ভালাে চেয়ার টেবিল পাওয়া গেলাে না? শুনলাম ভালাে চেয়ার টেবিল কিনতে হবে। গুদামে নেই। বললাম, কিনে নেন এবং পনেরাে মিনিটের মধ্যে আপনার কক্ষের চেয়ারগুলাে এ কক্ষে পৌঁছে দেন। ধমকে কাজ হলাে। মহাপরাক্রমশালী সদস্য (প্রশাসন) স্বয়ং প্রথম চেয়ারের সাথে উপস্থিত হলেন এবং অচিরেই আমার জন্যে বরাদ্দকৃত কক্ষে পর্দা উঠলাে। ছােট্ট কার্পেট এল এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসও এল।
এতে একটা সুফল হলাে, ওয়াপদাতে তিনটি শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন ছিলাে এবং প্রত্যেকেই আমার যাবতীয় পদক্ষেপ গভীর মনােযােগের সাথে লক্ষ্য করছিলাে। সদস্য (প্রশাসন) সাহেব ছিলেন তাদের জন্যে সবচাইতে প্রয়ােজনীয় ব্যক্তি। সেই সদস্য (প্রশাসন) সাহেবই যখন আমার জন্যে এতো মনােযােগী হলেন তখন আমিও তাদের মনােযােগ পেতে সক্ষম হলাম। প্রথমে এলেন সরকারি দলের মুখপাত্র। তখনও সরকারি দল ততােটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেনি। পুরােনাে প্রভাব কাটিয়ে নতুন দলের বিস্তৃতি ঘটাতে সরকারি প্রশ্রয় প্রয়ােজন এটাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা করছি এমন সময়ে ধড়াম করে দরজা খুলে গেলাে। চমকে মাথা তুলে দেখি এক দশাসই চেহারার লােক দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে, বাজখাই গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি এম. পি. সাহেব”?
বিনীতভাবে বললাম, হ্যাঁ। তারপরে বললাম, “আপনি কি আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দেবেন? হাতের কাজটা শেষ করেই আপনাকে ডাকবাে।"
ভদ্রলােক চলে যাবার সাথে সাথেই আমার সামনে উপবিষ্ট শ্রমিক নেতার মুখে স্বতঃস্ফূর্ত ধারা বিবরণী শুত্রু হলাে। যার সারমর্ম হলাে, তিনি একজন মুক্তিযােদ্ধা এবং সৎলােক। শেখ সাহেবের আমলে মাননীয় মন্ত্রী সারনিয়াবাত সাহেব তাকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং তিনি ভেতরকার খবরাখবর সংগ্রহ করে মাননীয় মন্ত্রী মহােদয়কে সরবরাহ করতেন, এর উপর ভিত্তি করে অনেক গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন মন্ত্রিমহােদয়। কিন্তু এ লােকটি ভীষণভাবে আনপপুলার হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের পট পরিবর্তনের পরে অনেকের সাথে তিনিও প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আত্মগােপন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে জিয়াউর রহমান সরকার ক্ষমা প্রদর্শন করলে তিনি ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরে আসলেও এখনও কেউ তাকে বিশ্বাস করে না, তাই এখনও তার কোনাে পােস্টিং হয় নি।”
ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় একে বিদায় করে ভদ্রলােককে ডাকলাম। এবার অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দাঁড়িয়ে দুই গােড়ালি একত্র করে ঠক করে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট করলাে। বসতে বললেও দাঁড়িয়ে থাকলাে।
জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন্ ধরনের পােস্টিং এ আপনি আগ্রহী”?
প্রশ্নের আকস্মিকতায় ভদ্রলােক হকচকিয়ে গেলেন, ধপ করে বসে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে যে কাহিনী শােনালেন তা যেমন হৃদয়বিদারক তেমনি করুণ। তার পােস্টিং ছিলাে নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক হিসেবে। অনেক অপচয় এবং অপসারণের তথ্য তিনি উদ্ধার করেছিলেন যার ফলশ্রুতিতে অনেক ছিদ্র বন্ধ হয়েছিলাে। অনেক প্রলােভনেও যখন তাকে টলানাে সম্ভব হয়নি তখন পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টের ঘটনাবলির সুযােগে তার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছিলাে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বরিশাল সেক্টরে সবচাইতে বড় দালাল একজন পীর সাহেবকে তিনিই জীবন ভিক্ষা দিয়েছিলেন। এখনও তিনি পুরাে ওয়াপদার বিরাগভাজন এবং এ কারণেই তাকে কেউ সহ্য করতে পারে না। একজন এম. পি. সাহেব এসেছেন শ্রমিকদের অসন্তোষ সম্বন্ধে জানতে এটা কেমন যেনাে বােধগম্য হয়নি। তাই অমন অভদ্রের মতাে দরজা খুলে ঢুকেছিলেন, ভেবেছিলেন এটাও বােধ হয় আরেকটি প্রহসন। তার এ অভদ্র ব্যবহারের জন্যে তিনি খুবই লজ্জিত। টেলিফোন তুললাম, সদস্য (প্রশাসন) কে বললাম, “অমুক সাহেবকে কােথায় পােস্টিং দিয়েছেন? বললাম তাকে তার পূর্বের পােস্টিং এ বহাল করুন”।
এর পরে আমি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এলাম এবং ওই লােক বিশ্বস্ততার সাথে নিঃস্বার্থভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনও তিনি অনেকের বিরাগভাজন। আমার বিবেচনায় কোনাে ভুল হয়নি। সৎ যােগ্য এবং নিঃস্বার্থ লােকেরা খুব কমই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই একটি সংক্ষিপ্ত রিপাের্ট তৈরি করে দিলাম। প্রেসিডেন্ট সাহেব হেলাভরে একপাশে রেখে দিলেন। অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলাে। আমার এ পরিশ্রমের কোনাে মূল্য পেলাম না। দু’দিন পরে মাননীয় মন্ত্রীর দপ্তর থেকে আহবান। গিয়ে দেখি আমার রিপাের্টের উপর প্রেসিডেন্টের নির্দেশ তার টেবিলে। শ্রমিক নেতাদের সাথে বৈঠক হলাে, চুক্তি সই হলাে। সমস্যা এবং অসন্তোষের একটা আপাত সমাধান হলাে। মন্ত্রণালয়ের বাইরে থেকে শিল্প অঞ্চলের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ একজন জনপ্রতিনিধি যে খােলা মন নিয়ে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করবেন সেটা কোনাে সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে কতখানি সম্ভব তা বিচার্য বিষয়। কেননা সেই প্রেক্ষিত কিংবা চিন্তাধারা টেবিলের এ পাশে অনুপস্থিত।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার এ পদ্ধতি একজন লােকের যােগ্যতাকে বিকশিত করার পক্ষে অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং যতদিন তিনি যােগ্যতার মাপকাঠিতে লােক নিয়ােগ করেছেন ততদিন সুফল পাওয়া গিয়েছিলাে। যেই অন্যসব উপাদান কিংবা চাপ প্রভাব বিস্তার করতে থাকলাে তখনই বােধ হয় শুরু হলাে বিপত্তি”
(দৈনিক আজাদী, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮৬) — এল কে সিদ্দিকী / ফেলে আসা দিনগুলি ও অন্যান্য ॥ [ এশিয়া পাবলিকেশনস - জুলাই, ২০০৩ । পৃ: ৪৬-৪৮ ]
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: