মাঠের সব নিয়ন্ত্রণ চান ডিসিরা
প্রথম নিউজ, অনলাইন: আসন্ন জেলা প্রশাসক সম্মেলনে তিন শতাধিক প্রস্তাব বাস্তবায়নের সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব ও সুপারিশ পাঠানো হয় বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে।
আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনের ডিসি সম্মেলন শুরু হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই দিন তেজগাঁওয়ে নিজ কার্যালয়ে সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে যুক্ত থাকবেন। বিকেলে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অধিবেশনগুলো শুরু হবে।
মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। তাঁরাই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মাঠ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
একজন ডিসি জেলার অন্তত ৩০২টি কমিটির প্রধান। এর পরও মাঠের আরো ক্ষমতা চান তাঁরা।
ডিসিরা নতুন করে যে ক্ষমতা চাইছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জেলা পুলিশের এসিআর দেওয়া, কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে তাঁদের প্রতিনিধি রাখা, ডিসির অধীনে বিশেষ ফোর্স গঠন, অপরাধ ডেটাবেইস ও এনআইডি ডেটাবেইস সার্ভারে ডিসি ও ইউএনওদের প্রবেশাধিকার, উপজেলা পরিষদের কর্মচারী নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের বদলে উপজেলার সরকারি বাসা বরাদ্দের ক্ষমতা।
প্রতিবছর ডিসি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে ডিসিদের সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়ে থাকে।
এ বছর সংসদ ও স্পিকার না থাকায় অধিবেশন আয়োজনসূচিতে দুটিই এবার থাকছে না বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সরকারের নীতিনির্ধারক ও ডিসিদের মধ্যে সামনাসামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার জন্য প্রতিবছর ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ডিসিদের পাঠানো প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাঁরা মাঠ প্রশাসনে আরো ক্ষমতা চান। সব কিছুতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। উপজেলা পরিষদের কর্মচারীদের নিয়োগ ও বদলি ডিসিদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্যা।
কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পাশাপাশি কর্মচারীদের জবাবদিহি ও দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা এবং বদলির মাধ্যমে কর্মচারীদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয় উপজেলা পরিষদ। গাড়িচালকদের বদলির ক্ষমতা আন্ত উপজেলায় ডিসি এবং আন্ত জেলায় বিভাগীয় কমিশনারদের।
পুলিশের এসিআর নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন একাধিক ডিসি। তাঁরা পুলিশ প্রবিধান ১৯৪৩-এর ‘৭৫/এ’ ধারা উল্লেখ করে বলেছেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিবছর জানুয়ারিতে জেলায় কর্মরত পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাজ নিয়ে তাঁর সাধারণ মূল্যায়ন বিভাগীয় কমিশনারের কাছে দেবেন। বিভাগীয় কমিশনার সেই প্রতিবেদনে নিজের মতামত যুক্ত করে তা পাঠাবেন সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের উপপুলিশ মহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কাছে।
গাইবান্ধার ডিসি চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ বলেছেন, অনেক আগে থেকেই জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রধান দায়িত্ব। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে মূলত পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের সার্বিক আচার-আচরণ ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়—এমন বার্ষিক প্রতিবেদন বিধানসংবলিত পুলিশ প্রবিধানের ধারাটি কার্যকর নেই। এ কারণে প্রায়ই সরকার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
সাতক্ষীরার ডিসি মোস্তাক আহমেদ প্রস্তাবে লিখেছেন, জেলা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ডিসি। উপজেলা পর্যায়ে সভাপতি থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর ডিসি ও ইউএনওদের কোনো দাপ্তরিক নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাজ নিয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি ডিসি ও ইউএনওদের নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।
গত ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে ‘জনপ্রশাসনের সংস্কারকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করে দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্রের’ প্রতিবাদে যৌথভাবে যৌথ প্রতিবাদসভা করেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। সেখানেও তাঁরা পুলিশের এসিআর দেওয়ার দাবি জানান।
জানা গেছে, সামরিক শাসনকালে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে ডিসিদের প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি অকার্যকর হয়ে যায়। এটি চালু করা নিয়ে পুলিশের আপত্তি রয়েছে। জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ডিসি। প্রতি মাসে কমিটির সভা হয়। তবে সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যান না জেলার এসপি। তাঁর বদলে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, জেলা প্রশাসন নির্বাহী বিভাগের অধীন, পুলিশও তেমন। একটি নির্বাহী বিভাগ কেন আরেকটি নির্বাহী বিভাগের কাছে জবাবদিহি করবে। এই জবাবদিহি হওয়া উচিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অথবা বিচার বিভাগের কাছে।
পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে ডিসির প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন অন্তত দুজন ডিসি। মাগুরার ডিসি অহিদুল ইসলাম বলেছেন, নিয়োগটি স্থানীয়ভাবে হয়ে থাকে। তাই সেই নিয়োগে ডিসির প্রতিনিধি থাকলে নিয়োগপ্রক্রিয়া অধিকতর স্বচ্ছ, ফলপ্রসূ ও গ্রহণযোগ্য হবে। এ ছাড়া পিআরবি ও ১৯৪৩ সালের পরিদর্শক ও এর নিচের পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যের সক্ষমতা ও পারফরম্যান্স দেখার দায়িত্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ারভুক্ত। একই ব্যাখ্যা তুলে ধরে প্রস্তাব করেছেন মানিকগঞ্জের ডিসি ড. মনোয়ার হোসেন মোল্লা।
ডিসির অধীনে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি বিশেষ ডিটেক্টিভ ফোর্স গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন মাগুরার ডিসি অহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ ধরনের ফোর্স থাকলে অবৈধ উচ্ছেদ অভিযান, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সুরক্ষা পাওয়া যাবে। এ ধরনের তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে বিদ্যমান বিভিন্ন বাহিনীর সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নিতে সময়ক্ষেপণ হয়।
তিনি অপরাধ ডেটাবেইস ও এনআইডি ডেটাবেইস সার্ভারে ডিসি ও ইউএনওদের প্রবেশাধিকারের প্রস্তাব করেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি ডিসি ও ইউএনওরা। তাঁদের এ ক্ষমতা দেওয়া হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
ইউএনওদের বাসভবন ও শারীরিক নিরাপত্তায় অঙ্গীভুত আনসারের বদলে সার্বক্ষণিক ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন মাগুরার ডিসি।
উপজেলার সরকারি বাসা বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠন করার প্রস্তাব করেছেন পিরোজপুরের ডিসি মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান। তিনি বলেছেন, বর্তমানে সরকারি বাসা বরাদ্দ কমিটির সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিব উপজেলা প্রকৌশলী। উপজেলায় বিদ্যমান সরকারি বাসা-বাড়ি ও ভবনাদি ব্যবস্থাপনা টেকসইভাবে কার্যকর করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিলে কার্যক্রম বেগবান হবে।
এ ছাড়া জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন অনেক ডিসি। পুলিশের হাতে চায়নিজ রাইফেল, সাব-মেশিনগান (এসএমজি), ৯ এমএম পিস্তলের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র না রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন সিলেটের ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তিনি বলেন, জনবিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্র ও ছররা গুলি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ছররা গুলিও মানবদেহে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কর্তব্যরত অবস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে তাদের বডি ক্যামেরা ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন সিলেটের ডিসি। এ ছাড়া সার্কিট হাউস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও ডিসির বাসভবনকে কেপিআই (কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) ঘোষণা করা এবং সে অনুযায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বগুড়ায় সিটি করপোরেশন করা ও উড়োজাহাজের বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালুর সুপারিশ করেছেন সেখানকার ডিসি হোসনা আফরোজা।