কোন পথে দেশের রাজনীতি?
প্রথম নিউজ, অনলাইন : ২০২৪ সালের শেষ সময়গুলো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। ২০২৫ সালেও কি তেমন কিছু হবে, এই প্রশ্ন নতুন বছরকে ঘিরে নাগরিকদের মনে আসতেই পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আলোচনা আরও প্রবল হয়েছে। কেননা জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, দ্রব্যমূল্য কমবে, জনজীবনে সংকট দূর হয়ে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা তৈরি হবে কিন্তু সেটা হয়নি।
যে কারণে নতুন বছরকে ঘিরে মানুষের আশা ও আশঙ্কার দুই-ই আছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ড. ইউনূসের ভাষণের পর মনে হয়েছে নতুন বছর বুঝি আমাদের জন্য খুব একটা স্বস্তিকর হবে না। তিনি তাঁর ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের একটা সম্ভাব্য ভাবনা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬-এর মাঝামাঝিতে নির্বাচন হতে পারে।
কেন তিনি নির্বাচনের একটি পরিষ্কার সময় দিতে পারছেন না, তার একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।’
নির্বাচন নিয়ে তাঁর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তাদের বক্তব্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো যদি তিন মাসের প্রস্তুতিতে নির্বাচন করতে পারে এই সরকার কেন অতিরিক্ত সময় নেবে? তারা বলেছে, তিন থেকে ছয় মাসের প্রস্তুতিতেই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন সম্ভব। সেটা না হওয়াতে তারা নানা দুরভিসন্ধির ইঙ্গিত করেছে। ২০২৫ সালের শুরুতেই নির্বাচন হতে কোনো সমস্যা নেই বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করে ও বিশ্লেষণ করে বের করেছি, এ ক্ষেত্রে সংস্কারে চার থেকে পাঁচ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়।
’
নির্বাচন নিয়ে এমন ভাবনা শুধু বিএনপির নয় অন্য রাজনৈতিক দলও অভিন্ন মত পোষণ করে। যদিও জামায়াতে ইসলামী সরকারকে সংস্কারের জন্য আরও সময় দিতে চায়। তাদের এই সময় দিতে চাওয়ার কারণ হিসেবে যে কৌশলের কথা জানা যায়, তারা দল গুছিয়ে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়। একটি জাতীয় দৈনিকের এক প্রশ্নে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘কিছু বিলম্ব জাতি মেনে নেবে, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়।’
২৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির এক জনসভায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য আবার সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছেন...।’ তাঁর এই বক্তব্য এসেছে ড. ইউনূসের নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য ধারণা দেওয়ার এক সপ্তাহ পরে। তাঁরা দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছেন। বিএনপি যদি দ্রুত নির্বাচনের জন্য আন্দোলনে নামে তাহলে প্রশ্ন তারা মিত্র হিসেবে কাদের পাবে? আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে অন্য দলগুলোর মধ্যে আছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, মধ্য-বামদলগুলো। কিন্তু এই দলগুলো কি নির্বাচনের ইস্যুতে তাদের সমর্থন করবে?
আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল। বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা প্রধান মামলাগুলো থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হলেও তিনি কেন দেশে আসছেন না বা আসতে পারছেন না, জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, এটা কি তাহলে ‘মাইনাস টু ফর্মুলার’ অংশ। এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পাওয়া না গেলেও, অনুমান করা কঠিন নয়। প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির ওপর দিয়ে অনেক বিপর্যয় গেছে। এমতাবস্থায় ক্ষমতার বাইরে যত দিন থাকবে তাদের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যে এই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, ক্ষমতাবাজির অভিযোগ উঠছে। এ ক্ষেত্রে মূল নেতৃত্বের ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও স্থানীয় পর্যায়ে তা সামান্যই অনুসরণ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় একটি নতুন রাজনৈতিক দল (কিংস পার্টি) গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। যতটুকু জানা যায়, সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার এই সময়ের মধ্যে তারা দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে তৈরি করে ভবিষ্যৎ সরকার গঠন করতে চায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজনৈতিক উদ্যোগ’ বলে ঘোষিত জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের এবং ফ্যাসিবাদীর যারা দোসর রয়েছে, তাদের বিচারের আগে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না (প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর)।’
আওয়ামী লীগ এখন সারা দেশে ছাত্র-জনতার ক্রোধ ও প্রতিহিংসার কবলে। তারা কীভাবে রাজনীতিতে সংগঠিত হবেন, ঘুরে দাঁড়াবেন তার হয়তো সে কৌশল ভাবছেন। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা অনলাইনে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত তার দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন। সুতরাং এ মুহূর্তে তাদের মাথায় নির্বাচন কীভাবে আছে সেটা প্রশ্ন। তাদের কাছে হয়তো প্রধান ইস্যু হামলা, মামলা-মোকাবিলা করা ও কারাবন্দিদের মুক্ত করা। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের ইস্যু তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে। বিএনপি যদি নির্বাচনের ইস্যুতে নিঃসঙ্গ হয় সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গী হতে পারে। অনিশ্চিত নির্বাচনের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দলকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
বিএনপির আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান যদি অনড় থাকে তাহলে পরিস্থিতি জটিল ও অরাজক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি সেনাবাহিনী সমর্থন কোন পর্যায়ে থাকবে, সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি শক্ত অবস্থান নেয় সে ক্ষেত্রে বিরোধীদেরও শক্তির পরিধি বাড়াতে হবে। জামায়াত যদি এই প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়, তার সঙ্গে কিংস পার্টি যুক্ত হয় তাহলে রাজনীতিতে একটি ভিন্ন মেরুকরণ ও শত্রুমিত্রের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও কোনো এক সমীকরণে মাঠে চলে আসতে পারে। বলা হয়, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রুমিত্র ও শেষ কথা বলে কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে তারা যদি বিএনপির সঙ্গে কোনো বোঝাপড়ায় আসে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আগ বাড়িয়ে তা বলাও হয়েছে। সে রকম বাস্তবতা তৈরি হলে নতুন বছরে রাজনৈতিক সংগ্রামে দুটি প্রধান ধারা দৃশ্যমান হবে। সে ক্ষেত্রে আন্দোলন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সমীকরণ কী হতে পারে?
(১) ক্ষমতার প্রধান দাবিদার বিএনপি কি নির্বাচনে এককভাবে করবে না জোটগত? ইতোমধ্যে তাদের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারের একটা ঘোষণা আছে। কিন্তু তার অংশীদার কারা, কীভাবে হবে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কেননা এই মুহূর্তে তাদের কোনো জোট নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেটা হলে কারা থাকবে, তা বিএনপিকে কী সুবিধা দেবে সেটা প্রশ্ন।
(২) জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো কি আলাদা জোট করে নির্বাচন করবে? তাদের সঙ্গে প্রক্রিয়াধীন নতুন পার্টির কি কোনো বোঝাপড়া হবে? সেটা হলে তা বিএনপির জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ হবে তার ওপর ভিত্তি করে হয়তো তারা কৌশল নির্ধারণ করবে।
(৩) আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয় যদিও প্রকাশ্যে তাদের কাজকর্ম নেই। বিএনপি ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রশ্নে তাদের মতামত স্পষ্ট করেছে, নির্বাচন নিয়েও তাদের আপত্তি নেই। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সে ক্ষেত্রে তারা উল্লেখিত এই দুই ধারায় কাদের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করে তার ওপর নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল।
(৪) এই বাইরে ছোট-মাঝারি অনেক দল আছে নির্বাচনের হিসেবে তারা প্রভাবক না হলেও তাদের সামাজিক অবস্থান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তারা সবাই মিলে যদি এক বৃহত্তর যুক্তফ্রন্টের মতো কিছু একটা করে ভালো প্রার্থী দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, সেটাও দৃশ্যমান একটি ধারা তৈরি হতে পারে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বছরের শেষে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে প্রশ্ন ও শঙ্কা তৈরি করেছে, তা নতুন বছরকে প্রভাবিত করবে। সেটা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনের ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ সরকারের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও নানা ইস্যুতে তারা ইমেজ সংকটে ভুগছে। তাই কথার মারপ্যাঁচে ধূম্রজাল সৃষ্টি না করে সংস্কার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ হাজির করা জরুরি। সেটাই হবে সম্ভাব্য আসন্ন রাজনৈতিক জটিলতা এড়ানোর পথ। সেটা না করতে পারলে একজন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তি নিন্দিত হবেন সেটা কারও কাম্য নয়।
লেখক : ড. মঞ্জুরে খোদা, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক