মত-মতান্তর মানুষ অথবা পোকামাকড়ের জীবন যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান

. তখন প্রতি শনি-রবিবার পুলিশ কাস্টডিতে আমি পুলিশ সার্জন হিসেবে ডিউটি করতাম

মত-মতান্তর মানুষ অথবা পোকামাকড়ের জীবন যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান
মত-মতান্তর মানুষ অথবা পোকামাকড়ের জীবন যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান

প্রথম নিউজ, ডেস্ক : ১. তখন প্রতি শনি-রবিবার পুলিশ কাস্টডিতে আমি পুলিশ সার্জন হিসেবে ডিউটি করতাম। যুক্তরাজ্যের পুলিশ হাজতে একজন আসামিকে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা ধরে রাখার নিয়ম রয়েছে। এর ভেতরে সন্দেহভাজন আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে না পারলে কোন অভিযোগ ছাড়াই ছেড়ে দিতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পুলিশ সংগ্রহ করতে পারলে, আসামির বিরুদ্ধে CPS(Crown Prosecution Service) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (চার্জশিট) অনুমোদন করবে। এবং অভিযোগের ধরনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আসামিকে বেইল দেওয়া হয়। অথবা পরের দিন আদালতে হাজির করতে হয়।

২. হত্যা, মারামারি, ধর্ষণ, চুরি ডাকাতি- সব অভিযোগের ক্ষেত্রেই উপরের নিয়ম কার্যকর। আসামিকে যখন হাজত বা কাস্টডিতে নিয়ে আসা হয়, তখন পুলিশ বা আসামির কোন ইনজুরি থাকলে তা সঙ্গে সঙ্গে কাস্টডির ডিউটিরত নার্স বা ডাক্তারের কাছে সংশ্লিষ্ট সার্জেন্ট রিপোর্ট করেন। আসামির কোন ইনজুরি থাকলে তা রেকর্ড করা ছাড়াও সাথে সাথে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়। ইনজুরি বা রোগ জটিল হলে ৯৯৯-এ কল করে এম্বুলেন্সের মাধ্যমে নিকটস্থ হাসপাতালে পুলিশ প্রহরায় পাঠানো হয়।

৩. পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় ( এখনো মাঝেমধ্যে যেতে হয়) কখনো কোন আসামিকে তাদের আইনজীবী ছাড়া পুলিশকে জেরা বা জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখিনি। পুলিশ এটা করতে পারে না।
বিজ্ঞাপন
সরকারি খরচে বিনামূল্যে আইনজীবীদের একটি তালিকা রয়েছে। কোন আসামি ইচ্ছে করলেই এই তালিকা দেখে যে কাউকে পছন্দ করতে পারেন। অথবা নিজস্ব খরচে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন। কেউ যদি ইচ্ছা করেন তাহলে কোন আইনজীবী ছাড়া সরাসরি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে পারেন। তবে শেষের দৃশ্য খুবই বিরল।

৪. পুলিশ হাজতে আসামির উপর পুলিশের হাত দেওয়া অসম্ভব। পুলিশ কোনোভাবেই তা করতে পারে না এবং করে না। আমি কখনো কোনো আসামিকে পুলিশের হাতে হেনস্থা হতে দেখিনি। পুরো পুলিশ কাস্টডি/ হাজত সিসিটিভির আওতায়। আসামিকে নির্যাতন করা তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে কোনো বাজে মন্তব্য করলে তার সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড হয়ে যাবে। সেই রেকর্ড আদালতের কাছে যাবে। সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তখন অবধারিত। আইনজীবীর উপস্থিতিতে আসামিকে পুলিশ যে  প্রশ্ন করে তা রেকর্ড করে রাখতে হয়। উল্টাপাল্টা প্রশ্ন বা ভয় দেখানোর সুযোগ নেই। গায়ে হাত দেওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।

৫. আমার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় কখনো শুনিনি যে, কোনো আসামি আদালতে গিয়ে বলেছেন যে, আমাকে পুলিশ হাজতে শারীরিক  নির্যাতন করা হয়েছে। এমন অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কাস্টডির পুলিশ অফিসার, সার্জেন্ট এবং ইন্সপেক্টরকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।

৬. যা বলছিলাম। কাস্টডির ভেতরে এক মাতাল আসামিকে  দেখার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার ডায়াবেটিস ছিল। আমি যখন তাকে মেডিকেল রুমে কিছু প্রশ্ন করছিলাম তখন সে তার মেজাজ হারিয়ে ফেলে। ধাক্কা মেরে আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা ছাড়াও চেয়ার ছুঁড়ে মার।একটুর জন্য বেচেঁ যাই। নিজের নিরাপত্তার জন্য পেনিক বাটনে টিপ দেই। মুহূর্তের ভেতর কয়েকজন পুলিশ অফিসার মেডিকেল রুমে হাজির। সংশ্লিষ্ট আসামি দু'জন পুলিশ অফিসারকে ধাক্কা মারে মেঝেতে ফেলে দেয়। বাকিরা তাড়াতাড়ি আসামিকে হাতকড়া পরিয়ে তার রুম বা সেলে নিয়ে যায়। হাতকড়া পরানোর জন্য ধাক্কাধাক্কি করা ছাড়া, আসামিকে কোনো পুলিশ অফিসার গালাগালি বা মারধর করেনি। করার কথাও নয়। সবকিছু ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে। মাথার উপর ক্যামেরা ঝুলছে!

৭. একটু পরেই কাস্টডির সার্জেন্ট এবং ইন্সপেক্টর আমার রুমে আসেন। আমার খোঁজখবর নেন এবং এ ঘটনায় আমি কী করতে চাই তা জানতে চান। যেহেতু আসামি আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করেছে, সে হিসাবে আমি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারি। এই অভিযোগের উপর চার্জশিট হতে পারে। এবং আদালত এ ব্যাপারে শাস্তি নির্ধারণ করবে। 

৮. আমি তখনও ভয়ে কাঁপছিলাম। আসামির ওপর আমার ক্ষোভ তখন তুঙ্গে। আমার সাথে আক্রান্ত পুলিশ অফিসারদের কাউকেই আসামির বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ দায়ের করতে দেখলাম না। আমিও পিছু হটলাম। আমার রাগ কমে এসেছে। আর এভাবেই পুলিশ হাজতের ভেতরে আসামি কর্তৃক শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আমি এবং বাকি পুলিশ অফিসাররা  আসামির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকি। 

৯. আমরা কেন এমনটা করি? প্রথম কথা হলো, আসামি  intoxicated ছিল। অনেক কিছুই সে বুঝতে পারছিল না। তারপর, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার কারণে স্বাভাবিকভাবে সে পুলিশের উপর খুব রাগান্বিত ছিল। কিন্তু তার রাগ মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা আমাদের রাগ কন্ট্রোল করেছি। কন্ট্রোল করতে হয়। কন্ট্রোল করতে হবে। এটাই নিয়ম। এটাই সভ্য সমাজের ভদ্র ব্যবহার। তুমি অধম তাই বলে আমি উত্তম হবো না কেন?

১০. ২৯ ডিসেম্বর ২২, বাংলাদেশের রাজধানীতে কয়েকটি রাজনৈতিক বড় মিছিল হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের (জামায়াতে ইসলামী) সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়া মিছিলের  ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে পুলিশের সাথে কিছু কর্মীর ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের বেধড়ক পিঠিয়েছে। জবাবে গুটিকয়েক কর্মী পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়েছেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করেছেন। কিছু পুলিশ আহত হয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

 

শুধু স্লিঙ বা ব্যান্ডেজ নয়, একদম প্লাস্টার করা! কে ভাঙলো এ হাত?


১১. একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মিছিলে পুলিশ কেন বাধা দিল বা হামলা করলো তা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে অপারগ। ঘটনার সময় কোনো গাড়ি ভাঙচুর বা সম্পত্তির উপর আঘাত চোখে পড়েনি। এরপরেও কেন এমন ঘটনা ঘটলো তার কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। এই নিয়ে আমি আর কোনো প্রশ্ন করছি না। তবে আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়।

 

উনার হাতের এ অবস্থা করলো কে? আদালত নিশ্চয়ই পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছেন!

১২. ঘটনার পরের দিন আগের দিন গ্রেফতারকৃত কিছু রাজনৈতিক কর্মীর  ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে হতভাগ্য লোকগুলোর হাত পা এবং মাথায় ব্যান্ডেজ। চেহারা বিধ্বস্ত। অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারছেন না। গ্রেফতারের সময় উনাদের কারো গায়ে এই ব্যান্ডেজ ছিল না। তাহলে এ ব্যান্ডেজ আসলে কোথা থেকে? বলা হচ্ছে তাদের  হাত পা ভেঙে গেছে। কে ভাঙলো? কোথায় ভাঙলো? কীভাবে ভাঙলো? আমি বিশ্বাস করি সম্মানিত আদালত পুলিশকে প্রশ্নগুলো করেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে কী ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা জানার বড় ইচ্ছে। নাকি কোনো প্রশ্নই করা হয়নি?

কলার ধরে চড় থাপ্পড় দেওয়া এখন অনেকটা স্বাভাবিক!

১৩. পুলিশের ওপর কেউ হামলা করলে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তাদের  বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে পারে। আদালত অভিযোগের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটলো কোথায়? এ প্রশ্নগুলো কি আদালত করেছেন? 

 পুলিশি হেফাজতে থাকা এ ভদ্রলোকের চেহারাই বলে দিচ্ছে তাঁর সাথে কী হয়েছে!

১৪. পরিবর্তে আমরা কিছু অস্থিরতা লক্ষ্য করছি। আমাদের কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছি। দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে  আঘাতপ্রাপ্ত পুলিশকে সংশ্লিষ্ট আসামি বা রাজনৈতিক দলকে শায়েস্তা করার জন্য প্রকাশ্যে উৎসাহ দেওয়ার বক্তব্য এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। এ ধরনের তৎপরতা কোনো সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীতে বসে অন্ধকার যুগের মানুষের মতো কথা বললে মনে হবে যে আমরা আমাদের মনুষ্যত্ব ও বিবেককে হত্যা করেছি।  

১৫. অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- বাংলাদেশের কিছু মানুষের জীবন  এখন পোকামাকড়ের মতো। তাদের কোনো অধিকার থাকতে নেই। তাদের হাড়গোড়, ডানা ভেঙে ফেললেও কারও  বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ক্ষমতা নেই। পায়ের নিচে পিষে ফেললেও তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই! কিন্তু তারা তো এ রাষ্ট্রেরই  রক্তমাংসের মানুষ! দেশের সন্তান। মনে হচ্ছে বাঁচতে হলে তাদের মনুষ্য পরিচয় ভুলে যেতে হবে।