ভ্যাট বৃদ্ধি : ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’

ভ্যাট বৃদ্ধি : ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’

প্রথম নিউজ, অনলাইন :   ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার ঘোষণা আসার পর থেকেই সাধারণ মানুষের মনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং অবশ্য বলেছে, “অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো করতে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।” কিন্তু সবাই আশঙ্কা করছেন যে, অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো করতে গিয়ে জনগণের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরো বাড়বে এই আশঙ্কায় সবাই অস্থির হয়ে পড়েছেন।

তবে মানুষের এই ভয়কে উড়িয়ে দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, ‘ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।’ অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অর্থ উপদেষ্টার এই বক্তব্য মানুষকে আরো ভড়কে দিয়েছে। উনি কীভাবে ভাবছেন যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো সত্তে¡ও বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। খুব সম্প্রতি উনি এও আশ্বাস দিয়েছেন রোজার আগে আর নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হবে না। ওনার এই আশ্বাস জনজীবনে কোনোভাবেই স্বস্তি ফিরিয়ে আনছে না, বরং উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। কারণ ওনার কথাতেই স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে রোজার পরে জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়তেই পারে।

অর্থ উপদেষ্টার সাথে গলা মিলিয়ে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারও বলেছেন, অর্থবছরের মধ্যে হঠাৎ করে অর্ধশতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর যে বাড়তি শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, তাতে মানুষের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। কীসের উপর ভিত্তি করে সরকারের উপদেষ্টারা ও প্রেস উইং এমন অর্বাচীন মন্তব্য করছেন, তা আমরা বুঝতে পারছি না। বিগত সরকারের আমলেও কর, ভ্যাট বৃদ্ধি নিয়ে এধরনের মন্তব্য আমরা শুনেছি, সমালোচনাও করেছি। বর্তমানের জনবান্ধব সরকারও যখন একইধরনের উক্তি করে, তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না।

    সরকারের উচিত ছিল ধনীদের ওপর সরাসরি কর আরোপ করা এবং দুর্নীতি ও কর ফাঁকি রোধের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করা। অথচ সেই আয়বৈষম্যের রাজনীতি থেকেই গেল। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, ভোক্তা পর্যায়ে মূসক (ভ্যাট), কর্পোরেট খাত- সবখানেই কর আদায় কমে গেছে। এর মানে হলো, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, আয় কমে যাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য কমছে। আর এই ঘাটতি পূরণের জন্য ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

জিনিসপত্রের দাম যে হঠাৎ করে বেড়েছে তা নয়। গত সরকারের আমল থেকে চলে আসা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের এমনিতেই চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা। ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন করে ভ্যাট আরোপের ফলে আরও ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে অনেক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী সরকারের সময় বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের অধীনে যে-সব কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ছিল, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে বা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিছু কিছু টিকে আছে কোনোভাবে। ফলে অসংখ্য মানুষ বেকার হয়েছেন, বেতন-ভাতা কমেছে অনেকের। শুধু নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্তরাও এই অবস্থার বলি হয়েছেন এবং হচ্ছেন। বিভিন্ন সংস্থা থেকে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়ে। মোট কথা কর্মজীবী সাধারণ মানুষ আর্থিক শূন্যতার মধ্যে পড়েছেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সরাসরি কর বৃদ্ধি করছেন না ঠিকই কিন্তু এর পরিবর্তে পরোক্ষ কর আরোপ করা হচ্ছে। এই পরোক্ষ করের প্রভাব শুধু গ্রাম ও শহরের দরিদ্র শ্রেণির উপরেই নয়, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপরেও চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ আমরা জানি যে ভ্যাট পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ যখন তার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনবেন, তখন বেশি দামে তাকে তা কিনতে হবে। ফলে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রতিটি দ্রব্য ক্রয়ে তাকে বাড়তি টাকা গুণতে হবে, তাছাড়া সাধারণ মানুষ তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে।

অনেকেই সমালোচনা করছেন যে ধনীদের ওপর সরাসরি কর আরোপ না করে এ ধরনের পরোক্ষ কর রাজস্ব আহরণের সহজ পন্থা হতে পারে, কিন্তু তা সমাজের আয় বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলবে। শুল্ক-কর বাড়ানোর কারণে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব সরকারি কোষাগারে ঢুকবে। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, এই ১২ হাজার কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই যাবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে। কারণ, পণ্যের ভ্যাট দিতে হয় প্রতিটি নাগরিককে।

ট্যাক্স বাড়ালে শুধু ধনী, উচ্চ মধ্যবিত্তকে বাড়তি আয়কর দিতে হতো। তাই অনেকের পরামর্শ দিচ্ছেন যে, ভ্যাট বাড়িয়ে সীমিত আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের ওপর বোঝা না চাপিয়ে, আয়করের আওতা বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো হোক। ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সব ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। দেশের দরিদ্র ও মধ্য আয়ের মানুষের কথা না ভেবে, যদি শুধু আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য ভ্যাট বাড়ানো হয়ে থাকে, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হয়।

পত্র-পত্রিকাগুলো বলছে, যে ভ্যাট কবে আরোপিত হবে, এর আগেই বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে বাজারে। রেস্তোরাঁগুলো ক্রেতার কাছ থেকে বিলে বাড়তি ভ্যাট আদায় করছেন। পোশাকের নতুন দাম কার্যকর করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা, মোবাইল ফোনের কল ও ইন্টারনেটের বাড়তি খরচ কেটে নিচ্ছে অপারেটরগুলো। এছাড়া পুরোনো চালানের মজুত শেষ হয়ে নতুন পণ্য বাজারে এলে সেগুলোর দামও বাড়বে। নানা কারণে পণ্য উৎপাদন খরচ আগে থেকেই বেড়েছিল, এখন সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে খরচের সীমা মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

সীমিত আয়ের মানুষের কষ্টের অন্যতম মূল কারণ দ্রব্যের ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি। বাড়তি ভ্যাট-ট্যাক্সের কারণে খাদ্য ছাড়াও চিকিৎসা, পরিবহণ, শিক্ষা খরচ অনেক বাড়বে। শিশু খাদ্যও ছাড় পাবে না। আর তাই অফিস-আদালতের আলাপে, চায়ের দোকানের আড্ডায় মূল্যবৃদ্ধি নিয়েই আলোচনা চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে এই ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করেছেন। সরকারের এই প্রয়াস সেইসব মানুষের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, যারা ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতির চাপে আছেন। সাধারণ মানুষ বেশ আগে থেকেই ধারদেনা ও কম খাওয়ার উপর ভিত্তি করে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন। এবার যে অবস্থা আরো কতটা কঠিন হবে, তা কে জানে।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেখানে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৩ সালে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পর্যবেক্ষণে জানা যায়, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ আয়কর দেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত হলেও আয়কর দেয় মাত্র ৪৫ হাজার। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকির কারণে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার আয়কর থেকে বঞ্চিত। অন্তর্বর্তী সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে কিংবা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে সরল রাস্তার সমাধান হিসেবে ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে নিশ্চিত করেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ আরও বাড়বে। (সূত্র: প্রথম আলো)

অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুবই বৈষম্যমূলক উপায়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। যেখানে বিশ্বের সবদেশেই রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত হলো প্রত্যক্ষ কর। যার যতো টাকা, সে ততো বেশি আয়কর দেবেন। যার টাকা কম, তারা কম আয়কর দেবেন, আর যাদের টাকা নাই, তারা আয়কর দেবেন না।

লক্ষ্য করছি সরকার সরকারি ব্যয়, আমলা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি কিছু কমাচ্ছে না। বরং বাড়তি মহার্ঘ ভাতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা দেখেছি বিগত আওয়ামী সরকার নানাভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে অনেক অনৈতিকভাবে সুবিধা দিয়েছে। অথচ এখনো দেখছি পূর্ববর্তী সরকারের সেই নীতিই অনুসরণ করা হচ্ছে। এভাবে ভ্যাট না বাড়িয়ে সরকার প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে ও কর আরোপ করে ঘাটতি মেটাতে পারে।

জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নানাবিধ সংকটে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি ভালো নয়। চলতি অর্থ বছরের চার মাসে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় বাড়তি রাজস্ব আদায় করার জন্য ভ্যাট বাড়ানোর এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। কিন্তু ভ্যাট বৃদ্ধি, টিসিবির কার্ড বাতিল ও ট্রাক সেল বন্ধে সাধারণ মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তাছাড়া এবার রোজায় সাধারণ মানুষের জন্য কম দামে মাছ, ডিম, মাংস বিক্রির সিদ্ধান্তও স্থগিত করা হয়েছে। প্রতিবছর রোজায় যে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়, সেটা নিয়েও উদ্বেগে রয়েছেন ক্রেতারা।

প্রমাণিত হয় যে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে স্বস্তি ও সুখ কোনোদিন মেলে না। যখন আমরা নতুন করে ভাবছি যে, জনতার সরকার এমন কোন পথ খুঁজে বের করবে, যার মাধ্যমে জনজীবন সংকট থেকে মুক্তি পাবে, ঠিক তখনই ভ্যাট আরোপ করে দেশের মানুষের উপর বড় পাথর চাপিয়ে দিলো সরকার।

সরকারের উচিত ছিল ধনীদের ওপর সরাসরি কর আরোপ করা এবং দুর্নীতি ও কর ফাঁকি রোধের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করা। অথচ সেই আয়বৈষম্যের রাজনীতি থেকেই গেল। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, ভোক্তা পর্যায়ে মূসক (ভ্যাট), কর্পোরেট খাত- সবখানেই কর আদায় কমে গেছে। এর মানে হলো, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, আয় কমে যাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য কমছে। আর এই ঘাটতি পূরণের জন্য ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।