নতুন মেরুকরণের পথে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

প্রথম নিউজ, অনলাইন : সিরিয়ায় পিতা-পুত্রের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। মাত্র ১২ দিনের আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য গতির কাছে মাথা নত করতে হয়েছে একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী আসাদ পরিবারকে। আরব বসন্তের সময় যে বিদ্রোহের সূচনা, এর ১৩ বছর পর এভাবে সাফল্য এসে ধরা দেবে বিদ্রোহীদের কাছে, সেটি মনে হয় তারা নিজেরাও কল্পনা করতে পারেনি। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেমন পরিবর্তন এসেছে, ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে মধ্যপ্রাচ্য তথা বৈশ্বিক রাজনীতিতে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামর্থ্যের ক্ষেত্রে এটি যেমন এক বড় ঝাঁকুনি দিয়েছে, বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিনদের প্রভাব রোধে রাশিয়ার শক্তিমত্তাকেও এই ঘটনা প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
সিরিয়ায় আসাদবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস বেশ খানিকটা পুরনো। আরব বসন্তের শুরুতে যে দেশগুলোতে সরকার পতন ঘটেছিল, সে সময় থেকেই সিরিয়ার বিদ্রোহীরা দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই বিদ্রোহীদের সমর্থনে সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রণতরি পাঠানোর প্রস্তুতি পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছিলেন।
বাদ সেধেছিল রাশিয়া। বলা যায়, রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন প্রভাবেই এত দিন ধরে বাশার আল-আসাদ টিকে ছিলেন। সঙ্গে ছিল ইরানের সমর্থন। ইরান সরকারের বিপ্লবী গার্ড ও আল কুদস বাহিনীর সক্রিয় সমর্থনে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা তেমন একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, বাশার আল-আসাদের পতনের পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেখানকার অনেকগুলো বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যার সর্বাগ্রে ছিল হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস। এই এইচটিএসের নেতা মোহাম্মেদ আল-জোলানি একসময়ের আল-কায়েদার নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যিনি আল-কায়েদার আদর্শের ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় ব্রতী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং আরো পরে আল-কায়েদা এবং আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে স্বতন্ত্রভাবে সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যান। আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ নতুন মেরুকরণের পথে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিঘোষিত হন। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, আসাদ সরকারের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে, যদিও তা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের তরফ থেকে এখনো জানানো হয়নি।
এত অল্প সময়ের মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আসাদ সরকারের পতনের পেছনের কারণগুলো নিয়ে এরই মধ্যে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। মাত্র ১২ দিনের আন্দোলনে ইরান ও রাশিয়ার মদদপুষ্ট একটি শক্ত শাসকের এভাবে পতন হবে—বিষয়টি মেনে নেওয়া রাশিয়ার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশের হস্তক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক করেছে। তবে এ কথা সত্য যে যা ঘটেছে, তা বেশ সুপরিকল্পিতভাবেই ঘটেছে, যার জন্য ইরান ও রাশিয়ার মনোযোগকে পাশ কাটিয়ে ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করেছে। তুরস্কের ভূমিকাও এখানে উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কপন্থী সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বিদ্রোহী এইচটিএসকে সহায়তা করে আসছিল। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের বৈপরীত্য থাকলেও আসাদ সরকারের বিষয়ে তাদের নীতি ছিল অভিন্ন।
মধ্যপ্রাচ্যের লেবানন এবং গাজা সংকট আসাদের পতনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে। আসাদের শক্তির পেছনে ছিল লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আসাদের প্রতি লেবাননের সমর্থন এবং হিজবুল্লাহর তরফ থেকে বিদ্রোহীদের তৎপরতা রোধের বিষয়টি বরাবরই চাউর ছিল। সেই হিজবুল্লাহ সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে নিজেরাই অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে থাকে। সেই সঙ্গে রয়েছে নেতৃত্ব সংকট। ইরান সমর্থিত হওয়ার কারণে লেবাননের হিজবুল্লাহর পেছনে শক্তি বিনিয়োগ করতে গিয়ে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিষয়ে ইরানের মনোযোগও কমে আসে। রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সিরিয়ার বিষয়ে তাদেরও মনোযোগ লোপ পায়। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে একদিকে গাজা আর অন্যদিকে হিজবুল্লাহ এবং থেকে থেকে সিরিয়ার ওপর হামলার কারণে দেশটির সামরিক শক্তি যতটা না বিদ্রোহীদের আতঙ্কে ছিল, এর চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে। সুযোগ বুঝে বিদ্রোহীরা অগ্রসর হওয়ার মওকা পেয়ে যায়। এসব কারণের সঙ্গে আসাদ সরকারের নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব নিয়েও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। তিনি অনেকাংশেই দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২৭ নভেম্বর যখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে অগ্রসর হওয়া শুরু করে, এর মাত্র চার দিনের মাথায় একরকম বিনা বাধায় গুরুত্বপূর্ণ আলেপ্পো শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। অগ্রসর হতে থাকে হামার দিকে, সেখানেও একই কায়দায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রাজধানী দামেস্কে ঢোকার পথে উল্লেখযোগ্য শহর হোমসের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তাদের কাছে। বিদ্রোহীদের এমন অগ্রসরমাণ তৎপরতার পর আসাদের মিত্র হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে তার সমর্থনে এগিয়ে আসার প্রস্তাব দেওয়া হয়। অবশ্য তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট আসাদের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে তখন থেকেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। বাস্তবে তা-ই ঘটল।
এখন একটি সংগত প্রশ্ন আসতে পারে, আর তা হলো মার্কিনদের চোখে নিষিদ্ধ এই এইচটিএস ও এর নেতা মোহাম্মেদ আল-জোলানির পেছনে কেন এবং কোন স্বার্থে মার্কিন ও ইসরায়েলের তরফ থেকে সমর্থন দেওয়া হয়। এর উত্তরে বলা যায়, প্রথমত, তাদের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো সমর্থন দেওয়া হয়নি, বরং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমন্বিত কৌশল বিদ্রোহীদের অগ্রসর হওয়ার পথকে সহজ করে দেয়; দ্বিতীয়ত, ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাশিয়ার। সে সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একমাত্র মিত্র দেশ সিরিয়ার শাসক আসাদকে টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের প্রচেষ্টাই নিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্যে ২০১৫ সালে বিদ্রোহীদের রুখতে এবং আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হাজার হাজার সেনা প্রেরণ করে রাশিয়া। ২০১৭ সালে সিরিয়ার নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে হেমেইমিমের বিমানঘাঁটি ও তারতুসের নৌঘাঁটি ৪৯ বছরের জন্য রাশিয়াকে ইজারা দেয়। এর ফলে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে তাদের শক্ত ভিত গড়ে তোলে। বর্তমানে বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রাশিয়ার শক্তির ক্ষেত্রে এক বড় প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হলো। প্রশ্ন উঠছে, তাদের এই ঘাঁটিগুলোর কী অবস্থা হবে? এ ক্ষেত্রে বিদ্রোহীরা যদি এগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে বসে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন আধিপত্য অপ্রতিরোধ্য থেকে যাবে।
তবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণে যা বোঝা যাচ্ছে, তা হচ্ছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী শিগগিরই মার্কিনদের সঙ্গে হয়তো কোনো ধরনের আপস-মীমাংসায় যাবে না। তাদের বিদ্রোহের কৌশল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা সহিংস কোনো ধরনের নীতির পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায়। তারা এমন কোনো পদক্ষেপ হয়তো নেবে না, যার মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হতে হয়, যা গৃহযুদ্ধ এবং পরিবর্তনের সাফল্যকে আরো কঠিন করে তুলবে। রাজধানী দামেস্ক দখলের পরই তারা আসাদের অনুগত বাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের আনুগত্যের বিনিময়ে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেয়। সুন্নি অধ্যুষিত এই বিদ্রোহীরা শিয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে যত্নশীলতার পরিচয় দিয়েছে। যখনই তারা শিয়া অধ্যুষিত কোনো গ্রামে প্রবেশ করেছে, কোনো ধরনের আক্রমণ না করে বরং আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। এর মধ্য দিয়ে মূলত যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, তা হচ্ছে সিরিয়ার সব জাতি তাদের মধ্যে কার্যত প্রেসিডেন্ট আসাদের প্রতি পুঞ্জীভূত ঘৃণাকে এই পরিবর্তনের পেছনে কাজে লাগিয়েছে। একই বিষয় প্রযোজ্য দেশটির সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও। দীর্ঘ সময় ধরে গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে গিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা কাজ করেছে।
সিরিয়া বর্তমানে আসাদের স্বেচ্ছাচারী শাসন থেকে মুক্ত হলেও আসাদের পতনের পর ইসরায়েলের তৎপরতা নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর সিরিয়ার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে তারা ২৫০টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। তারা দাবি করেছে, এর মধ্য দিয়ে তারা ইসরায়েলের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে। যুক্তি যা-ই থাকুক না কেন, এটি স্পষ্ট যে তারা গোলান মালভূমির সংযুক্তকরণের দিকে অধিক মনোযোগী। এরই মধ্যে তারা এর বাফার জোন নিজেদের দখলে নিয়েছে। এটিকে নিরাপত্তাজনিত কারণে সাময়িক পদক্ষেপ বললেও ইতিহাস কিন্তু বলে ভিন্ন কথা। অতীতেও তারা একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দখলদারি বাড়িয়েছে এবং চালিয়ে গেছে। ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনীতিকরা সিরিয়ার এই অস্থিতরতার সুযোগে নিজেদের ভূখণ্ডকে যদি আরো বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে থাকে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সার্বিকভাবে এটিই বলা যায়, সিরিয়ায় আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে একটি নতুন মেরুকরণের দিকে ধাবিত করতে যাচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়