প্রথম নিউজ, ঢাকা: জিয়াউর রহমান। শুধু একটি নাম নয়। জিয়া নামটি যেন বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে দেশের আজকের অবস্থানে আসার প্রতিটি বাঁকেই রয়েছে জিয়াউর রহমানের অসামান্য অবদান। ৮১ সালে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নির্মম ভাবে শাহাদৎ বরণ করলেও মৃত্যুর এত বছর পরেও তিনি এখনো সমান জনপ্রিয়। তার এই ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তাই শাসক দল ভীত হয়ে জিয়াকে ইতিহাসের খল নায়ক বানাতে মাঝে মাঝে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু ইতিহাস জিয়াকে কিংবদন্ত্বিতুল্য করে তুলেছে। তাই শত চেষ্টা করলেও জিয়াকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে কেউ পারবেনা।
জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন।চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।সেই ঘোষণা প্রথমবার নিজের নামে দিলেও দ্বিতীয়বার তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে দিয়েছিলেন।এর ফলে তাঁর যে ভাবমূর্তি দেশে এবং বিদেশে গড়ে ওঠে,আজও তা অম্লান। দেশ ও জাতির চরম বিপদের সময় তাঁর কণ্ঠস্বরে জনগণ উজ্জীবিত হয়েছিল।এটা তাঁর এক বিরাট অবদান। তাঁর সেই ভরাট গলার আহবানে বাঙালি জাতির মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছিল।
স্বাধীনতাযুদ্ধের নয়টি মাস কি প্রত্যয় নিয়ে জিয়াউর রহমান যুদ্ধ করেছিলেন,তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন, বীর বিক্রম শমসের মোবিন চৌধুরী : পরিবারকে
ফেলে রেখে জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহন করলে তাঁর স্ত্রী আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তখন চট্টগ্রামে যে বাড়ীতে বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই ছেলে
থাকতেন তার পাশ দিয়ে একদিন জিয়া তাঁর সেনাদল নিয়ে যাওয়ার সময় লেফটেন্যান্ট শমসের মোবিন তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে
যেতে চান কি না। সঙ্গে সঙ্গে জিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, আমার অধীনে থাকা ৩০০ সৈনিক যদি তাঁদের পরিবার ত্যগ করে আসতে পারে, তাহলে আমি আমার
পরিবারকে নিয়ে যেতে পারি না। ( প্রেসিডেন্ট জিয়া , মাহফুজ উল্লাহ পৃষ্ঠা-২৯)যুদ্ধের সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ উদ্ধিগ্ন ছিলেন জিয়া। সাবেক
পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রফেসর মুহম্মদ শামসুল হক লিখেছেন: “দীর্ঘ নয় মাস ধরে যখন তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে ঢাকা সেনা নিবাসে বন্ধি করে রাখা হয়েছিলো
তখন তিনি ধৈর্য্য ও সাহসের সঙ্গে গভীর মানসিক যন্ত্রণা ও কষ্ট সহ্য করে গেছেন তা আমাকে বেশী অভিভূত করেছে। শত্রু বাহিনী তাঁকে একের পর এক
চরমপত্র দিয়ে যাচ্ছিল আত্মসমর্পনের জন্য। পরিবারের নিরাপত্ত্বা নিয়ে একদিকে যেমন তাঁর গভীর মর্মবেদনা এবং অন্যদিকে দেশপ্রেমিক হিসেবে কর্তব্যের ডাক- এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে তাঁকে নিদারুনভাবে কষ্ট পেতে হয়েছিলো। কিন্তু বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে গেছেন।
সেই সময় ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার মেজর জেনারেল জামশেদকে ২১ আগষ্ট ১৯৭১ একটি চিঠি লেখেন জিয়া। পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত থাকাকালে জেনারেল জামশেদ তাঁর অধিনায়ক ছিলেন। জামশেদকে তিনি লেখেন, Dear General Jamshed, My wife Khaleda is
under your custody,If you do not her with respect, I would kill you someday. Major Zia.” চিঠিটি তিনি মেজর সাফায়াত জামিলকে দিলেন দেশের অভ্যন্তরে কাউকে দিয়ে ডাক বাক্সে ফেলার জন্য। দেওয়ানগঞ্জে পোষ্ট করা চিঠি সত্যিই জেনারেলের জামশেদের হাতে পৌঁছেছিলো পরবর্তীকালে। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছিল যুদ্ধের সময় থেকেই। যুদ্ধের সময় জেড ফোর্সের অবস্থান কোথায় হবে তা নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে জিয়ার মতবিরোধ ঘটে। তখন উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় তাঁর বাহিনীকে এমন অবস্থানে রাখা হয়েছিলো যার ফলে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের দিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি ঢাকায় উপস্থিত হতে পারেননি।স্বাধীনতাযুদ্ধে জেড ফোর্স অনন্য বীরত্ব প্রদর্শন এবং ব্যাপক ত্যগ
স্বীকার করে। ( প্রেসিডেন্ট জিয়া- পৃষ্ঠা ২৫-২৭)
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকার জিয়াউর রহমানের প্রতি খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। জিয়াউর রহমানকে উচ্চভিলাসী সামরিক কর্মকর্তা মনে করতেন শেখ মুজিব। আর তাছাড়া স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে সেনাবাহিনীতে জিয়াউর রহমানেরএকটা আলাদা কদর ছিলো। সৈনিকরা তাকে পছন্দ করতো। তিনি জনপ্রিয়তায় তার সমসাময়িক অফিসারদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। এই জন্য শেখ মুজিব সহ অন্যান্যরা তাকে ঈর্ষার চোখে দেখতেন। ভিশনারী হওয়া কারো জন্য দোষের কিছু হতে পারে না। বরং ভিশনারী না হওয়াটাই একজন মানুষ নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। এ বিষয়ে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ লিখেছেন: স্বাভাবিক নিয়মে জিয়াকেই সেনাপ্রধান নিয়োগ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু এই পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি সর্বদা চূড়ান্ত বিবেচ্য বিষয় নয়, বরং এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত নিয়োগদাতার মনোভাব ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভর করে, যিনি আগেভাগে ধারণা পেতে চান যে, কার সঙ্গে কাজ করতে তিনি স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করবেন- এক্ষেত্রে বিবেচনাটি হচ্ছে ‘কে আমার কথামত ভালভাবে কাজ করবে’।জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান না বানানোর আরো কারণ
ছিলো। ‘ তাঁকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয়নি, কারণ স্বাধীনতা ঘোষনার অনন্য কৃতিত্ব ছিল তাঁর। তার ওপর, শেখ মুজিবের বোনের ছেলে এবং আওয়ামী লীগের
তাত্বিক হিসেবে পরিচিত শেখ ফজলুল হক মনি চেয়েছিলেন সেনাপ্রধানের পদে শফিউল্লাহকে বসানো হেক, যিনি পেশাগত যোগ্যতায় জিয়ার চেয়ে খাটো ছিলেন।ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ মনে করেন: শফিউল্লাহ ছিলেন জিয়ার তুলনায় বশংবদ। অপর কারনটি হতে পারে,শেখ সাহেব জিয়াকে একজন প্রতিদ্বন্দি হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর মধ্যে গরহাজির নেতৃত্বের মানসিকতা কাজ করতো। শেখ মুজিব শফিউল্লাহকে ব্যক্তিগতভাবে ও রাজনৈতিক দিক থেকে অনুগত মনে করতেন। মুজিব জিয়াকে মনে করতেন উচ্চাকাঙ্খী। আরেকটি ব্যাখ্যা হলো,স্বাধীনতা ঘোষনার কারণে ‘ মুজিব জিয়ার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং মনে করতেন, এই তরুন অফিসার তার কতৃত্বের সীমা লঙ্ঘন করেছে, যার ফলে সেনাপ্রধানের পদের জন্য স্বাভাবিক প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেয় তাকে উপেক্ষা
করা হয়েছে। কিন্তু ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ ভোর রাতে ধানমন্তির বত্রিশ নম্বরের বাড়ি আক্রান্ত হলে মুজিব যখন শফিউল্লাহর কাছে সহায়তা চান তখন শফিউল্লাহ যে ভূমিকা পালন করেন তা প্রশ্ন বিদ্ধ থেকে গেছে।
সেনাপ্রধানের পদ থেকে জিয়ার বঞ্চিত হওয়ার অনেক ব্যাখা রয়েছে। লে.কর্নেল আবদুল লতিফ খান অব. বলেন, ভারতীয়রা চেয়েছিল শফিউল্লাহ কে সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হোক এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে জিয়ার ভূমিকার জন্য তারা তাঁকে পছন্দ করতো না।জেনারেল ওসমানী অব. এর অধিনায়কত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহন করলেও
তিনি জিয়াকে পছন্দ করেতন না। কিন্ত পরবর্তীকালে দায়িত্বপালনের সময়
জিয়া কখনো তার প্রাক্তন অধিনায়কের প্রতি কোন রকম অসম্মান প্রদর্শন করেন নি। যদিও শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগে জেনারেল ওসমানির একটা
ভূমিকা ছিল। ওসমানি এবং জিয়া উভয়ের ঘনিষ্টভাবে পরিচিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম প্রধান ক্যাপ্টেন নুরুল হক অব. বলেছেন, জেনারেল ওসমানি
জিয়াকে পছন্দ করেতন না এবং শেখ মুজিবকে তিনি বোঝান যে জিয়াকে সেনাপ্রধান করা ঠিক হবেনা, কারণ তিনি উচ্চাকাঙ্খী। এটা জিয়াকে খানিকটা
হতাশ করে। তবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জিয়াই সেনাপ্রধান হতেন।
ওসমানি এও জানতেন যে , জিয়া ছিলেন কঠিন পাত্র আর সেনাহিনীর ওপর মুজিবের কোনো আস্থা ছিলো না, কারণ তিনি মনে করতেন বাংলাদেশ সেনাহিনী
পাকিস্তান সেনাবাহিনীরই একটি নতুন সংস্করণ।
(মাহফুজ উল্লাহ / প্রেসিডেন্ট জিয়া/ রাজনৈতিক জীবনী/ ॥ [অ্যাডর্ন প্রকাশনি/ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ । পৃ: ৩১-৩৩])
অন্যদিকে ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার দেশপ্রেম, সততা, ঐকান্তিকতা ছিল সব সন্দেহের উর্ধ্বে। যদিও কর্নেল তাহেরের বিচার নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও ধুম্রজাল রয়েছে। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর ভেতরে যেভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলেন,সেটা ছিল এক ঘৃণ্য অপরাধ। অনেক নিরীহ মানুষকে তাঁর বিপ্লবী সংস্থা হত্যা করেছে। নিহতদের কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির কোন অভিযোগও ছিল না। অন্যদিকে জনগণের মধ্যে কর্নেল তাহেরের কোন ভিত্তি ছিল না। জাসদের যে গণবাহিনী ছিল, তারা বিভ্রান্তিকর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে...।
...তাহেরের কাজটি কোনো মূল্যবোধের পর্যায়ে পড়ে না। এটা কোন ধরনের দর্শন হতে পারে না। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাতে তাঁর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা স্লোগান দিয়েছে, ‘অফিসারের রক্ত চাই/সুবেদারের ওপরে অফিসার নাই।’ অর্থাৎ এটা প্ল্যানটেড কোন স্লোগান। বিদেশ থেকে আমদানি করা স্লোগান, যাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শক্ত ভিতের ওপর গড়ে উঠতে না পারে, । সেনাবাহিনী যদি গড়ে উঠতে না পারে, তাহলে যারা সুবিধাটা নেবেন, তাঁরাই এই কাজ করিয়েছিলেন। এ কারনেই জিয়া তাঁদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত এ্যাকশনে চলে যান। সেনাবাহিনীতে ডিসিপ্লিন বরখেলাপ করে যখনই কেউ কাজ করবে, ডিসিপ্লিন ভঙ্গের যে ধারাগুলো আছে, সেটা তাঁর ওপর বর্তাবে। সুতরাং বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কেউ তাঁকে জোর করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণেই বিচার। সেটা সংক্ষিপ্ত আকারেও সেনাবাহিনী করতে পারে। কোর্ট মার্শাল যেটা হয়, সেটা বৈধ এবং আইনগতভাবে এটার বৈধতা আছে।
.জিয়ার বিরুদ্ধে তার প্রতিপক্ষরা যে অভিযোগটি সব সময় করে সেটা হচ্ছে, জিয়া নাকি দেশে মার্শা ল জারি করেছিলেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে জিয়া কখনোই দেশে সামরিক আইন জারী করেননি।.. মূলত এরশাদই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সামরিক আইনের মাধ্যমে দেশ শাসন করেছিলেন। এর আগ পর্যন্ত সামরিক আইনের মাধ্যমে কেউ দেশ শাসন করেননি। জিয়া সামরিক আইন জারি করেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ক্ষমতায় এসে সামরিক আইন জারি করেন। জিয়া তাঁর অধীনে ছিলেন। পরে তিনি সায়েমের অধীনে ছিলেন। পরে যদিও জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি নিজে কোন ফরমান জারি করেননি। ... জিয়া দ্রুত সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণতন্ত্রে ফিরে গিয়েছিলেন।
(১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন/আমীন আহম্মেদ চৌধুরী/পৃষ্ঠা-১৭২-১৭৬/প্রথমা প্রকাশন/ তৃতীয় সংস্করণ/ চতুর্থ মুদ্রণ/২০১৬)
ব্যক্তিজীবনেও জিয়ার সততা ছিলো প্রশ্নাতীত। এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব বর্তমান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ইনাম চোধুরী লিখেছেন:"... শহীদ জিয়াউর রহমানের অবয়বে এক অকৃত্রিম খাঁটি মানুষ বিরাজ করত। আদর্শবান, নীতি-নিষ্ঠ, নিরহংকার জাতীয় স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ একজন বাংলাদেশী যার প্রথম ছিল বাংলাদেশ, শেষ ছিল বাংলাদেশ, চিন্তায় ও কর্মে সততা ছিল যার প্রথম কথা ও শেষ কথা। তাতে কোনাে ঘাটতি নেই, নেই কোনাে আপােস।
এই প্রসঙ্গে একটি ছােট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত অর্থনৈতিক মন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট জিয়া ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে সরকারি সফরে সস্ত্রীক এসেছেন লন্ডনে। সেখানে তার ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যে একটি ছিল গিল্ড হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্রিটিশ বাণিজ্যিক ও বিনিয়ােগ বিষয়ক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এক সমাবেশ। প্রেসিডেন্ট জিয়া ভাষণ দেবেন তার পর প্রশ্নোত্তর। নির্দেশ মােতাবেক একটি খসড়া তৈরি করে সফর সঙ্গী জনাব শফিউর আজম, হাই কমিশনার দোহা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হককে দেখিয়ে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমার্জিত করলাম।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন — মিটিং-এ যাবার আগে প্রেসিডেন্টকে দেখিয়ে নিন। শরণাপন্ন হলাম প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সাদেকুর রহমান চৌধুরীর। তিনি বললেন, “ইনাম ভাই, ফর্মালী দেওয়া যাবে না। সময় কম। তবে তার স্যুইটের পাশের রুমে বসে রাখার ব্যবস্থা করতে পারি। মহামান্য প্রেসিডেন্ট বেরুলেই তাঁর কাছে হাঁটতে হাঁটতে উপস্থাপন করা যেতে পারে। লিখিত ভাষণের পরে তিনি সম্ভবত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুখে কিছু বলবেন। গাড়িতে বসে আলাপ করা যেতে পারে।”
যা হােক — বসে আছি। হঠাৎ পাশের কক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কথােপকথনের একাংশ কানে এলাে। সবাই জানেন, বিদেশে গেলে সচরাচর তারা কোনাে কেনা-কাটা করতেন না। প্রয়ােজন বােধে এক জোড়া মােজা সম্ভবত বেগম জিয়া কিনেছিলেন। বললেন, “এক জোড়া মােজার দাম দেশী টাকায় এক শতেরও বেশি। এই দামে মােজা কেনা যায়?” আমার আর কিছু কেনার নেই ভাগ্যিস। উত্তর এলাে ‘এ’ দামে আমাদের কেনার দরকারও নেই, সামর্থ্যও নেই। গরিব দেশের নির্ধন প্রেসিডেন্ট। যখন দেশের মানুষের সঙ্গতি হবে, প্রেসিডেন্টেরও হবে। অপর দিকে সম্মতি সূচক নীরবতা।
স্তম্ভিত বিস্মিত চিত্ত আমি। সাদামাটা সততার কি আশ্চর্য সুন্দর নিদর্শন। এক মহান রাষ্ট্রনায়ক আর তার এক মহীয়ষী সহধর্মিণী। কালে এই মহিলাই আবির্ভূত হলেন দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দেশনেত্রী হিসেবে প্রয়াত স্বামীর সুযােগ্য উত্তরসূরি দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী – দেশের প্রথম মহিলা সরকার প্রধান, আর বর্তমানে বিরােধী দলসমূহের জননন্দিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া॥"- ইনাম আহমেদ চৌধুরী / ভাবনায় বাংলাদেশ ॥ [ হাসি প্রকাশনী - মে, ২০০৯ । পৃ: ১৪৯ ]
বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে জিয়াউর রহমান কঠোর পরিশ্রম করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় হয়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল ছিলো স্বাধীনতা। কিন্ত অল্প দিনের মধ্যে স্বাধীনতা আনন্দ মিলিয়ে যায় । হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে জাতি।পরিবর্তনের জন্য ব্যকুল হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বাংলার ইতিহাসের গতি পরিবর্তনের নায়ক শেখ মুজিব অচীরেই হয়ে ওঠেন দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার এক খল নায়ক। ১৯৭২-৭৫ শেখ মুজিবের শাসন ছিলো মানুষের কাছে একটা তীক্ত
অভিজ্ঞতা। দুর্ভোগে ক্লান্ত দিশেহারা জনগন দেখে দুর্ভিক্ষ, একশ্রেনীর মানুষের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন, বিরোধীদের ওপর নির্য়াতন, রক্ষীবাহিনীর বিচারবর্হিভূত গুপ্ত হত্যা, গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ, মৌলিক অধিকার হরণ, ৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি। এ সময় শ্লোগান তৈরী করা
হয়েছিলো এক নেতা-এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আইনের শাসন নয়,মুজিবের শাসন চাই। মুজিববাদ নামে নতুন একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা চলে। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশের মানুষের মনে দেখা দেয় অজানা শংকা ও অনিশ্চয়তা। জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই ২৫ শে জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে
মাত্র ১১ মিনিটে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী কার্যকর করার মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ মানে বাকশাল
কায়েম করা হয়। একদলীয় শাসনের অধিনে নিয়ে আসা হয় দেশকে। রচিত হয় স্বাধীনতা ও গণত্ন্ত্রের সমাধি।পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর, প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমতায় এসে ফিরিয়ে দেন বহুদলিয় গণতন্ত্র, ফিরিয়ে দেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও। শুধু তাই নয় জিয়াউর রহমান মনোযোগ দেন দেশগড়ার কাজে। পাশপাশি আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মনোনিবেশ করেন কুটনতিক তৎপরতা। ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে জিয়া তৎপর হয়ে পড়েন। জিয়া গঙ্গার পানির ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৩ জানুয়ারি ১৯৭৬ সাল, বাংলাদেশের জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনই
প্রথম বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের উপর ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা তুলে ধরা হয়। বলিষ্ঠ কন্ঠে জিয়াউর রহমান ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বললেন, “উই মাস্ট গেট রাইটফুল শেয়ার অব
গ্যানজেন্স ওয়াটার’। কনফারেন্স হল স্তব্ধ বিস্ময়ে শুনলো এক জাতীয়তাবাদী নেতার যুক্তিপূৰ্ণ শক্ত-বাঁধুনী বক্তব্য। তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কাছে
আবেদন জানালেন, তাঁরা যেন এরকম একটি অতি জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে পার্শ্ববতী রাষ্ট্রের উস্কানিমূলক তৎপরতার কথাও বললেন। সমুদ্র আইন সংক্রান্ত নিউইয়র্ক সম্মেলনে জলসীমারেখা নির্ধারণের ব্যাপারে বাংলাদেশের ভূমিকার সমর্থন দানের জন্যে জেনারেল জিয়া মুসলিম দেশসমূহের নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। জেনারেল জিয়ার বক্তৃতা সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। মুসলিম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়া পূরণে বাংলাদেশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের উল্লেখ করে বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। আবদুর রহিম (সাংবাদিক) / সুপ্রভাত বাংলাদেশ ॥ [ ননী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ ।পৃ: ৭৪-৭৭ ]
শষ্য বিপ্লবে জিয়াউর রহমান যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার সেসব উদ্যোগ দেশবিদেশে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান নির্বাচন
কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা লিখেছেন:আমি ১৯৮১ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে এসেছি। অত্যন্ত মেধাবী,উন্নয়ন প্রশাসনে অভিজ্ঞ ও লক্ষ্য অর্জনে দুর্বার ও দৃঢ়চিত্ত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান আমার সচিব। প্রশাসন পরিচালনায় তার স্টাইল ছিল তার পছন্দের ও আস্থার ব্যক্তিদের বিভিন্ন পদে সমাসীন করে তাদের হাতে প্রশাসনের খুঁটিনাটি ছেড়ে দিয়ে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে মনোনিবেশ করা। কিছুদিন গেলে দেখি যে অন্য অনেক সচিবের মতো অধিকাংশ নথি তিনি পরে দেখবেন বলে
ধরে রাখতেন না। ফাইল খুলে দ্রুত স্বাক্ষর করে নথি নিষ্পত্তি করে দিতেন।তার বুদ্ধিমত্তা এত প্রখর ছিল যে কোন বিষয়গুলো তাকে ভালোভাবে দেখতে হবে, তা তিনি জানতেন এবং সেই নথিগুলো তিনি রেখে যেতে বলতেন।একদিন একটা নথি আমার হাতে দিয়ে সচিব বললেন, যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় আদেশ ও বিজ্ঞপ্তিগুলো জারি করো। আমার অফিসকক্ষে ফিরে
নথি খুলে বিস্ফারিত চোখে দেখি, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের আধুনিকায়নের জন্য তাদের লোকবল সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়ে একটা বিরাট অর্গানোগ্রাম তৈরি করা
হয়েছে, যেখানে শুধু পদসংখ্যাই বাড়ানো হয়েছে, তাই-ই নয়, অনেক নতুন নতুন পদও সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বিদ্যমান পদের মান উন্নীত করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে মহাপরিচালকের একটি পদ সৃষ্টি করে তাকে সচিবের বেতন স্কেল প্রদান করা হয়েছে, যা তখন শুধু বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা পরিষদের
নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের আর কোনো বিভাগীয় প্রধানের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। মোট ৩২ হাজার পদসংবলিত এই অর্গানোগ্রামের শেষ পাতায় তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সবুজ
কালিতে লেখা এরকম একটি অনুমোদন ছিল :
নথিতে রক্ষিত প্রস্তাবসমূহ অনুমোদন করা হল। সংস্থাপন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির কোন প্রয়োজন নাই;কৃষি সম্প্রসারণের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি স্বতন্ত্র বিভাগকে একক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই এই উদ্যোগ। এ ধরণের একীভূতকরণের জন্য ইতিমধ্যে অনেক সমীক্ষা হয়েছে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্বব্যংকও একাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়ে আসছিল।প্রস্তাবটির যৌক্তিকতা এবং যথার্থতা নিয়ে কোনো সন্দেহ কিংবা বিতর্কের অবকাশ নেই। সমস্যা হচ্ছে এর প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি নিয়ে। সরকারের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী যেকোনো প্রশাসনিক সংস্কার প্রস্তাব কিংবা অর্গানোগ্রামের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন কিংবা বিয়োজন প্রথমে
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ব্যাপক পরীক্ষা-নিরোক্ষার পর তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। এদের পরীক্ষা শেষ হলেই কেবল নথি রাষ্ট্রপতির কাছে তার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তবে এই দুটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে আমলাতান্ত্রিক মহলের ধারণা যে, এরা অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং বর্তমান যুগের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দৃষ্টিভঙ্গির যে প্রসারতা ও কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে সাহস দরকার,তা তাদের নেই। এরা দুইকে বাড়িয়ে বড়জোর চার করতে পারে; কিন্তু চারশ করার মতো সাহস এদের নেই। এসব শুনেই হয়তো রাষ্ট্রপতি ওই দুই মন্ত্রণালয়কে বাদ দিয়েই তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।রাষ্ট্রপতির আদেশ সত্ত্বেও, আমি জানি, সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের
সম্মতি ছাড়া এ আদেশ জারি করা যাবে না। তা করলে মহাহিসাব রক্ষক এদের বেতন-ভাতা দেবেন না। আমি যুগ্ম সচিব পর্যায় পর্যন্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আমার সচিবের কাছে ফিরে গিয়ে বললাম, স্যার, সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছাড়া এ বিজ্ঞপ্তি জারি করা যাবে না। নিচের পর্যায়ে কথা বলে ব্যর্থ হয়েছি। আপনি অর্থসচিবের সঙ্গে কথা বলুন। ওবায়দুল্লাহ খান অর্থসচিব গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে কথা বললে তিনি সব কাগজপত্র নিয়ে পরের দিন তার দপ্তরে আমাকে হাজির হতে বললেন। পাকিস্তান অডিট এন্ড একাউন্ট সার্ভিসের অন্যতম সদস্য গোলাম কিবরিয়া তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও জটিল বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমলাতান্ত্রিক মহলে বহুল আলোচিত ছিলেন। তিনি খুব দ্রুত বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলেন এবং তার সরাসরি হস্তক্ষেপে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনকৃত অর্গানোগ্রামটি ঠিক যেভাবে তিনি অনুমোদন করেছিলেন, সেভাবেই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হই। দেশের স্বাধীনতাকালে প্রায় ৯০ লাখ হেক্টর জমিতে বাংলাদেশ ৭০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছিল।উৎপাদন করেছিল। কৃষিযোগ্য সেই জমির পরিমাণ বর্তমানে অনেক হ্রাস পেলেও এখন বাংলাদেশ ৩ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ১৯৮১ সালের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের আধুনিকায়ন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে॥;
( এ টি এম শামসুল হুদা (সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার) / ফিরে দেখা জীবন
॥ [ প্রথমা প্রকাশন - ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ । পৃ: ১৪৬-১৪৭ ]
জিয়া বাংলাদেশের মানুষকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে বাংলাদশি জাতীয়তাবাদ। এ প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমান নিজেই বলেছেন:
এখন প্রশ্ন হলো: জাতীয়তাবাদ কি? ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, এ বিশ্বে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছে। ‘ রেসিয়াল বা জাতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা এ প্রসঙ্গে সর্ব প্রথম এসে যায়। আর ব ও জার্মান জাতীয়তাবাদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।..এরপর আসে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা। বাঙালী জাতীয়তাবাদের শ্লোগান এ ধ্যানধারণা থেকে উৎসারিত। এ কারণে আওয়ামী লীগাররা বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে এখনো বিভোর রয়েছে। আবার মুসলীম লীগ, আইডিএল এবং জামায়াতিরা বলে থাকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা।সত্য করে বলতে গেলে বলতে হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করতে গিয়ে বাংলাদেশকে শোষন ও শাসন চালানো হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে ‘ পলিটিকস অব এক্সপ্লয়েটেশন’ পাকিস্তানকে এক রাখতে পারলো না। প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করেও রাজনীতি চলতে পারে, গড়ে উঠতে পারে এক নতুন জাতীয়তাবাদ। তাই আমরা বলি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ।আমাদের আছে জাতিগত গৌরব, রয়েছে সমৃদ্ধশালী ভাষা এবং আছে ধর্মীয় ঐতিহ্য। ভৌগলিক অবস্থান হিসেবে আমরা এক গুরুত্বপূর্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। আমাদের আছে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার স্বপ্ন। আর এসব রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় অবগাহিত। একটা জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে এ উপাদানের সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি।তাই যদি কেউ যদি বলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধর্মকে অবলম্বন করে হচ্ছে না, তবে ভুল হবে। ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকা বাংলাদেশী জাতির এক মহান ও চিরঞ্জীব বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা আছে: ‘লা ইক্করা ফিদ্বীনে’, অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। সুতরাং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্মবিমুখও নয়। এ জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে কেউ যদি বলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবদ কেবল ভাষা ভিত্তিক, তবে সেটাও ভুল বলা হবে। আবার কেউ যদি বলে আমাদের কেবল একটা অর্থনৈতিক কর্মসূচী রয়েছে। কিন্ত কোনো দর্শন নেই , সেটাও ভুল। আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ফিলোসফিতে এবজরশন পাওয়ার আছে। এলবো রুমও রয়েছে। যদি কোথাও ঘাটতি থাকে, অন্যটি থেকে এনে পুরো করে দিতে পারবেন। আমাদের অলটারনেটিভ আছে। সেকারণেই আমরা টিকে আছি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে।....
জাতীয়তাবাদের টার্গেট হবে জনগন। কারণ জনগনই সকল শক্তির উৎস। এ জন্যই আমরা গ্রামে গ্রামে সংগঠন করছি। প্রতিষ্ঠা করেছি সামাজিক- অর্থনৈতিক স্বনির্ভর গ্রাম সরকার।প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতির একটা স্বপ্ন থাকে। তেমনি আমাদের মনেও রয়েছে অনেক স্বপ্ন। সে স্বপ্নই হলো দর্শন। এ দর্শন দিয়েই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়িত করতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখছি একটা শোষনমুক্ত সমাজ গঠনের। সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে সকলের অধিকার নিশ্চিত করার।...দুনিয়ার প্রত্যেকদিন একই থাকে না। আল্লাহ তায়ালা যখন নেচারই চেঞ্জ করছেন, তখন আপনার টার্গেট গুলো চেঞ্জ করবেন না কেন? আপনার চাহিদার ক্ষেত্রেও তো রদবদল হয়েছে।... খালি পেটে দর্শন হয়না, কাজও করা যায় না। রাজনীতি তো করা যায়ই না। তাই সর্বক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি আমাদের দর্শনের মধ্যে ধর্মীয় দর্শনও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত আছে।..... আমরা মানুষকে যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দিতে যাচ্ছি,তাতে তিন ধরনের খোরাক আছে। যেমন (১) ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য অন্নের সংস্থানের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির আহবান, (২) স্বাবলম্বী জীবনযাপনের জন্য অনুপ্রেরণা এবং (৩) পারলৌকিক জগতের জন্য প্রস্তুতিগ্রহনের মাধ্যমে আত্মার শান্তি অর্জনের প্রচেষ্টা। এ কারণেই আমরা বলছি,ধর্মের এলিমেন্ট যদি রাজনীতিতে না থাকে, তবে সেটাও ভুল হবে। ‘সেক্যুলার স্টেট” বলে অনেক দেশের পরিচয় দেওয়া হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসাবে ইংল্যান্ডের কথাই ধরা যাক। ’৭৭ সালে গিয়েছিলাম কমনওয়েলথ সিলভার জুবিলি উৎসবে। কথায় কথায় বাইবেল। কোনো কিছুই শুরু হয় না বাইবেল ছাড়া। তারা সেক্যুলার হলো তাহলে কোথায়? এরপর আসুন প্রতিবেশী ভারতের কথায়। সারা দুনিয়ার ‘সেক্যুলার স্টেট’ বলে সে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু আসলে কি তাই? না, আমার মতে ভারত সেক্যুলার নয়। একজন ভারতীয় সাংবাদিককে বলেছিলাম এ কথা। বলেছিলাম ভারতে উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সর্বক্ষেত্রেই হিন্দু ধর্মমত প্রতিপালিত হচ্ছে। অন্য ধর্মালম্বীদের যথার্থ মর্যাদা দেওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রতিবছর কতশত সংখ্যালঘু মারা যায়। এতে উক্ত সাংবাদিক রুষ্ট হলেন। কিন্তু রুষ্ট হলে কী করা যাবে? আমাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে ভারতীয়দের অবস্থা ভালো না হলেও তারা এটম বোম,ট্যাংক বানিয়ে চলছে।আমাদের কথা হলো , মানুষরে হাত-পা বেঁধে কিছু করতে চাই না।জিয়া তার বক্তৃতা বিবৃতিতে প্রায়ই উন্নয়নের রাজনীতি’র কথা বলতেন। তনি এটাও মনে করতেন যে জাতীয়তাবাদ কেবল একটা ধারণাগত বিষয় নয়, এটা এমন একটা প্রণোদনা,যা মানুষকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। ১৯৮১ সালে তিনি মার্কাস ফ্রান্ডাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এটা আমাদের আমাদের ভূমি।.... আমাদের ভূমি অনেক বিজেতা এসে নষ্ট করেছে। এখন সুযোগ এসেছে আমাদের এই ভূমি চাষাবাদ করি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াই। শিল্প গড়ে তুলি এবং মর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। আমাদের আস্থা রাখতে হবে নিজেদের শক্তিতে... কোনো বিদেশীবাদ নয়।- মহিউদ্দিন আহমদ / বিএনপি: সময়-অসময় ॥ [ প্রথমা প্রকাশন : ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ । পৃ: ১২৯-১৩১ ]
দেশ এখন পা দিয়েছে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে। মহাকালের হিসেবে এই সময়টা হয়তো বড় কোনো সংখ্যা নয়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের জন্য পঞ্চাশ আবার খুব একটা কম সময়ও নয়। এর চেয়ে কম সময়ে বিশ্বের অনেক জাতি, জ্ঞান বিজ্ঞান উন্নয়নে অনেক অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সঠিক এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি অনেক দেশের চেয়ে। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশকে উন্নত ,সমৃদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের জন্য যে ধরনের
কর্মসূচী এবং যে ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর আর কোনো সরকারই সেরকম ভিশন নিয়ে এগোনোর কথা ভাবেনি। জিয়া ছিলেন একজন ক্ষনজন্মা নেতা। আজ তিনি বেঁচে থাকলে দেশ নিশ্চই আরো উন্নত আরো সমৃদ্ধ আরো আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত হতো।জিয়া ছিলেন সত্যিকার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। শুধু যে স্বপ্ন দেখাতেন তাই। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিন রাত নিজে পরিশ্রম করতেন, অন্যদেরকে করতে অনুপ্রাণীত করতেন। আধুনিক বাংলাদেশের গোড়াপত্তন তিনিই করেছিলেন।
জাতীয় স্বকিয়তা,স্বাতন্ত্র,ঐতিহ্যকে তিনি নতুনভাবে পরিচিতি করে গেছেন।, আজ হয়তো তিনি নেই। কিন্তু তাঁর পথআছে,পথের দিশা আছে,আছে জনগন এবং এক অম্লান আদর্শ। জাতীয়তাবাদীদের তাই পথভ্রষ্ট হওয়া চলবে না। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশিত পথই তাদের পথ।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: