আফগানিস্তান নারীরা কেন জ্ঞানার্জন করতে পারবে না?  -   ড. মাহবুব হাসান

 আফগানিস্তান নারীরা কেন জ্ঞানার্জন করতে পারবে না?   -   ড. মাহবুব হাসান
 আফগানিস্তান নারীরা কেন জ্ঞানার্জন করতে পারবে না

প্রথম নিউজ, ডেস্ক : বিশ্ববিদ্যালয়ে আফগান মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারবে না। এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তালেবান সরকার। এর আগে আরও একটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে তালেবান সরকার। মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিকেও শিক্ষা নিতে পারবে না। তারা কেবল প্রাথমিকে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

তার মানে কী? এটাই যে কেবল পুরুষরাই জ্ঞানার্জন করতে পারবে? নারীরা কেন জ্ঞানার্জন করতে পারবে না? এই অধিকার কি তাদের ইসলাম দিয়েছে? ইসলামে কি নারী শিক্ষা ছিল না? বা নারীদের শিক্ষা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ? না, ইসলামে নারী শিক্ষার ওপর কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা নেই বরং ইসলাম ধর্মেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নারীকে পুরুষের পাশে সব বিষয়ে সমান অধিকারী করেছে।

ইসলাম কি ধর্মান্ধদের ধর্ম? নাকি জ্ঞান চর্চার প্রথম সোপান? আমাদের রাসুল সাল্লালাহু ওয়াইহি আসসালাম কি এ-কথা বলেননি যে প্রয়োজনে জ্ঞানার্জনে সুদূর চীন দেশে যাও। তাঁর সেই নির্দেশনায় তো এটা বলা হয়নি যে কেবল পুরুষরাই জ্ঞানার্জন করবে। নারীরা থাকবে গৃহবন্দি এবং গৃহকর্মী হবেন এবং সন্তান লালনপালনের কাজে ব্যস্ত থাকবেন?

বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে নেওয়ার সময় ইসলামই প্রথম নারীর মর্যাদা বিবেচনা করে কাবিননামা ধারার সৃষ্টি করেছে, যা মূলত ও মুখ্যত নারী এবং পুরুষের মধ্যে সম্পাদিত একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চুক্তি। এই চুক্তি যে পক্ষ ভাঙবে সেই দোষী সাব্যস্ত হবেন।

এই বিধান যে ধর্মে চালু করা হয়েছে ১৪শ বছর আগে, আজ ২০২২ সালের শেষে এসে আফগানিস্তানের মতো ইসলামিক রাষ্ট্র কোন বিবেচনায় নারীদের উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ করলো?

তালেবান শব্দের অর্থ তো আমরা জানি ছাত্র। অর্থাৎ যারা জ্ঞানান্বেষী। সেই জ্ঞান কেবল পুরুষদের জন্য কোরআনে এমন কোনো ধারা বা বর্ণনা নেই। এমন কোনো শব্দ নেই যেখানে নারীকে ছোট করে দেখা হয়েছে পুরুষকে একচ্ছত্র অধিকার দেওয়া হয়েছে।

তাহলে আফগানিস্তানের তালেবান শাসকরা কোন বিবেচনায় নারীর জন্য উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ করলেন? এর আগে তারা মাধ্যমিকের শিক্ষাও নিষিদ্ধ করেছে, যা কেবল সে দেশের নারীদের মানবাধিকার বঞ্চনাই নয়, তাদের বর্বর সমাজের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হলো আফগান কোনো নারী এনজিওতেও কাজ করতে পারবে না বলে ফরমান জারি করেছে সরকার।

মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো। নারীরা যদি ওই রকম অফিসে কাজ করেন তাহলে আফগানিস্তানের প্রশাসনিক অসঙ্গতি ও রাজনৈতিক দৃষ্টির খামতি ধরা পড়বে, যা আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে সহজেই চলে যাবে, এ ভয়েই সরকার এই ব্যবস্থা নিয়েছে।

এই ধরনের দেওয়াল তোলার মানে হচ্ছে সে দেশের নারীদেরই কেবল বন্দি করার অলিখিত উদ্যোগ নয়, নিজেদেরও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার আয়োজন, যা গর্হিত বলে মনে করা যেতে পারে। তালেবান সরকারের এই নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে নিন্দা জানিয়েছে কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র। তুরস্ক, পাকিস্তান, সৌদি আরব তার মধ্যে আছে।

‘আফগানিস্তানে ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিষিদ্ধ ঘোষণার নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব ও তুরস্ক। গত মঙ্গলবার ( ২০ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তালেবান। ক্ষমতায় আসার পর নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা হরণে এটি তালেবানের সর্বশেষ পদক্ষেপ।

তালেবানের এমন সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এ সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান ও কাতার।

বৃহস্পতিবার তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু তালেবানের প্রতি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করা ইসলামসম্মত কিংবা মানবিক কোনোটিই নয়। আমরা এ সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করি না। ইনশাআল্লাহ, তালেবান এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেবে।

সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে তালেবানের সিদ্ধান্তে ‘বিস্ময় এবং দুঃখ’ প্রকাশ করে বলেছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিষিদ্ধে তালেবানের এ সিদ্ধান্ত, সব ইসলামিক দেশকে বিস্মিত করেছে।’

গত বছর ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর তালেবান কঠোর ইসলামি আইন ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করেছে। তারা মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষাও নিষিদ্ধ করেছে। বিধিনিষেধের কারণে চাকরি করতে পারছেন না আফগান নারীরা। সূত্র: আল জাজিরা (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১২/২২/২২)

আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশ পাকিস্তান আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে। সেই নিন্দা জানানোর কাতারে আছে সর্বশেষ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ কাতার। সৌদি আরব ও তুরস্ক নিন্দা জানিয়েছে এই সিদ্ধান্তের। তালেবানের এই সিদ্ধান্তের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। আফগান নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা হরণের এ সিদ্ধান্তটি সর্বশেষ পদক্ষেপ।

এরপর তালেবান কি সিদ্ধান্ত নেবে? সেটা কি এই রকম যে গোটা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষাব্যবস্থাই তুলে দেবে? তালেবানদের এই ধরনের ইসলামবিরোধী সিদ্ধান্ত কেবল আফগানিস্তানকেই নয়, গোটা দুনিয়ার ইসলামি দেশগুলোকেও চরম লজ্জা আর ধর্মান্ধতার অন্ধকারে নিক্ষেপ করলো।

ইসলাম কি ধর্মান্ধদের ধর্ম? নাকি জ্ঞান চর্চার প্রথম সোপান? আমাদের রাসুল সাল্লালাহু ওয়াইহি আসসালাম কি এ-কথা বলেননি যে প্রয়োজনে জ্ঞানার্জনে সুদূর চীন দেশে যাও। তাঁর সেই নির্দেশনায় তো এটা বলা হয়নি যে কেবল পুরুষরাই জ্ঞানার্জন করবে। নারীরা থাকবে গৃহবন্দি এবং গৃহকর্মী হবেন এবং সন্তান লালনপালনের কাজে ব্যস্ত থাকবেন?

আফগান ছাত্র (তালেবান) সরকারের এই সিদ্ধান্তের নিন্দাই কেবল করছি না আমি, তাদের জ্ঞান-গরিমার ওপর থেকে সব ধারণা ও বিশ্বাসও তুলে নিতে হবে আমাকে। আমার মনে পড়ছে সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা। তিনি কাবুলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন সেই বহুকাল আগে। ঊনিশ ও কুড়ি শতক মিলিয়ে তার যাপিত জীবনের একটি দীর্ঘসময় কেটেছে কাবুলসহ সে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

আমরা তার বরাতেই জেনেছি সে দেশের মানুষদের ন্যায়পরায়ণতা ও প্রগতিশীল মানবিকতার কথা। জেনেছি তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কতোটা প্রবল ও স্রোতোস্বিনীর মতো বেগবান। সেই দেশে এই একবিংশ শতকে এসে একি দেখছি আমরা?

তারা কারও বশ্যতা স্বীকার করার মতো জাতিসত্তা নয়, এটা ইতিহাসের সত্যই কেবল নয়, সবাই তা জানে। সর্বশেষ জেনে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সেনা জীবনের কুড়ি বছর এই দেশে বাস করে গেছে বশ্যতা স্বীকারের কাজে। কিন্তু তাদের মাথা নোয়াতে পারেনি। আমরাও তাদের মাথা নোয়াতে বলি না, কিন্তু চলমান পৃথিবীর বাস্তবতা বুঝতে হবে তাদের।

জাতিকে অগ্রসর করে গড়ে তুলতে হলে কেবল পুরুষের শিক্ষা তেমন বলবান হবে না। নারী ও পুরুষের যৌথ শিক্ষাই গোটা দেশকে নতুন সম্পদে ভরে দিতে পারে। যেমন একটি পরিবার, স্বামী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়াসে, সহযোগে মজবুত হয়ে ওঠে, দেশও সেই রকম এক ব্যবস্থাধীন- এটা আফগান সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে।

প্রকৃতি আর জ্ঞান হচ্ছে সহোদরের মতো। নারী ও পুরুষ, সেই প্রকৃতি ও জ্ঞানেরই মতো। আশা করি, আফগান সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করে সব ধরনের স্বাধীনতাহরণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: