সভা-সমাবেশ করা সাংবিধানিক অধিকার: অনুমতি নেয়ার ধারণা বিভ্রান্তিকর
প্রথম নিউজ, অনলাইন: সভা-সমাবেশ করা বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সম্প্রতি রাজধানীতে বড় কোনো সভা-সমাবেশের প্রসঙ্গ আসলেই এই অধিকার কাদের আছে, কাদের নেই, এই অধিকার ভোগ করতে কোনো অনুমতি নেয়ার দরকার আছে কিনা, নেয়া হয়েছে কিনা, অনুমতি না চাইলেও বলা হয় অনুমতি দেয়া হলো - এসব নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ছড়িয়ে পড়ে জনমনে কনফিউশন। অনেক সময় দেখা যায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় আইন ও সংবিধান ভালো করে না জেনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ বা মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন মিসলিডিং প্রশ্ন করে বসেন এবং প্রশ্ন শুনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও তাদের মনমতো উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারকে এভাবে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় দেখা বা ছড়ানো বা ব্যাখ্যা করা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বিপজ্জনক।
সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।” লক্ষ্য করুন এই অনুচ্ছেদে কারো কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়ার কথা বলা হয়নি বা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র বলা হয়েছে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ দেয়া যেতে পারে দুটি কারণে। কারণ দুটি হলো- জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্য।
অপরদিকে সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ- সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধে চলাফেরার অধিকার দিয়েছে। নাগরিকদের নিজ দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অনায়াসে যাতায়াত করা, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গমন করা তাদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার চলাফেরায় বাধা দেয়া, তার গতিরোধ করা ও তল্লাশির নামে তাকে হয়রানি ও নাজেহাল করা এবং মোবাইল চেক করা অসাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসহ চারটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিককে তল্লাশি ও আটক থেকে নিরাপত্তা লাভের অধিকার এবং সব ধরনের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার (right to privacy) দিয়েছে।
সভা-সমাবেশ করার জন্য অনুমতি নেয়ার কনসেপ্টটাই বেআইনি, অসাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী। মৌলিক অধিকার চর্চায় অন্যের অনুমতি নিতে হবে কেন? সাংবিধানিকভাবে জনগণ হলো ক্ষমতার মালিক, কেননা সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ পরিষ্কার করে বলেছে , “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ”। আর সংবিধানের নবম ভাগ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রের কর্মচারী ও জনগণের সেবক হিসেবে নিয়োজিত। সুতরাং মালিক হয়ে সেবকের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার কনসেপ্ট বা ধারণাই বেমানান, গলদপূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত।
তবে হ্যাঁ, নাগরিকরা সভা-সমাবেশ আহ্বান করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা উচিৎ এবং আয়োজকদের এটা করা নাগরিক ও আইনি দায়িত্ব। এটা করা দরকার খোদ আয়োজকদের নিজেদের স্বার্থে এবং সমাজের শৃঙ্খলার রক্ষার্থে। ডিএমপি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬’তে কিংবা বা The Police Act 1861 - এ সভা-সমাবেশের জন্য অনুমতি নেয়ার কোনো বিধান নেই। বরং তাদেরকে অবহিত করার বিধান বা নিয়ম আছে। তবে সীমিত ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কারণে সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার এখতিয়ার বা ক্ষমতা আছে। যদি অনুমতি নেয়ার নিয়ম বা বিধান থেকেও থাকে তবে তা হবে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা কোন নিয়ম বা আইন সংবিধানের উপর বা সাংবিধানিক ধারার উল্টো হতে পারে না। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷”
গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পুলিশের পারমিশন বা অনুমতি নেয়ার বিধান বা প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে হ্যাঁ, পুলিশকে অবহিত করার বিধান ও আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। পুলিশ একেবারে নিরপেক্ষভাবে পেশাদারিত্বের সাথে আহ্বানকৃত সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানে সহযোগীতা করে। কনভেনশনাল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, একেবারে প্রান্তিক, বর্ণবাদী ও চরম ডানপন্থি দলগুলোও কোনো সভা-সমাবেশ করতে চাইলে তাদেরকে স্পেশাল প্রটেকশন দিয়ে এবং অনেক সময় চারদিকে কর্ডন করে (যাতে তাদের চরমপন্থী মতের কারণে তাদের বিরোধীরা আক্রমণ করতে না পারে) তাদের সভা-সমাবেশ ও র্যা লি (Rally) করতে দেয়। এটাই হলো প্রকৃত গণতন্ত্রের নমুনা, বাক-স্বাধীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বৃটেনে লালন করা হয় দার্শনিক বল্টেয়ারের সেই ঐতিহাসিক উক্তির মূল্যবোধকে যেখানে তিনি বলেছেন “I do not agree with what you say but I will defend to my death your right to say it” (অর্থাৎ “আমি আপনার কথার সাথে একমত নই তবে আমি আমার মৃত্যু পর্যন্ত আপনার বলার অধিকার রক্ষা করব”)।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে শোনা যায় “অমুক দলকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না যেহেতু তাদের নিবন্ধন নেই”, “অমুক দলের নিবন্ধন নেই তাই তাদেরকে রাস্তায় দাঁড়াতেই দেয়া হবে না”। এটা আইনের সঠিক ব্যাখ্যা নয়।
নির্বাচন কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বিধানটি শুধুমাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ নিবন্ধিত দলই কেবল দল হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে। এই নিয়মটি স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ছিল না। এটি করা হয়েছে ১/১১ এর জরুরি সরকারের সময়। নাগরিকের সভা-সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকারের সাথে নির্বাচন কমিশনের এই নিবন্ধনের বিধানটির কোনো সম্পর্ক নেই। দেশে রাজনৈতিক দল আছে শতাধিক। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সাথে নিবন্ধিত কয়টি দল আছে? অর্ধেক বা তারও কম হবে। তাই বলে যারা নিবন্ধিত নন এমন অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের সদস্যরা সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। লক্ষ্য করবেন সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদে যাদের চলাফেরা ও সভা-সমাবেশের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তাদের বেলায় শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে “প্রত্যেক নাগরিকের”। এখানে বলা হয়নি “নিবন্ধিত দলের” বা “নিবন্ধিত দলের সদস্যদের”।
পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। জনগণের আশা ভরসার প্রাথমিক জায়গা হবে পুলিশ এবং পুলিশের ফাঁড়ি বা থানা। পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানই হবে মডার্ন পুলিশিংয়ের ভিত্তি। আর এই ভিত্তির উপর ভর করে কোনো অস্ত্র বহন করা ছাড়াই বৃটেনে দক্ষতার সাথে পেশাদারিত্ব মেনটেইন করে পুলিশ সমাজে আইনশৃঙ্খলা চমৎকারভাবে বজায় রাখছে। চিন্তা করতে পারেন কতটুকু নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখলে পরে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে (বরিস জনসন) আইন ভঙ্গের দায়ে জরিমানা করতে পারে, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে (টনি ব্লেয়ার) তার ছেলের অপরাধের জন্য ছেলেকে নিয়ে সশরীরে থানায় গিয়ে মুচলেকা দিতে বাধ্য করা যায়!
পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানের জায়গা দুটি নষ্ট হবার কারণে ইদানিং আশংকাজনকহারে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা দেখলে গাঁ শিউরে উঠে। বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তারা এমন আচরণ করেন তাতে মনে হয় যেন ওরা ভিনদেশি শত্রু। আবার সুযোগ পেলে পুলিশকে পাখির মতো পিটিয়ে আহত বা নিহত করার চেষ্টা করা হয়। এমনটি হবে কেন? এই ঘটনাগুলোর গভীরে যাওয়া দরকার। লাঠি যেমন ক্ষতি করতে পারে যেমনটি করেছ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর, ঠিক তেমনি লগি-বৈঠাও একই ক্ষতি করতে পারে যেমনটি করেছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে। লাঠি ও লগি-বৈঠা নামক এ দুটি অস্ত্র সভা-সমাবেশে আনা সম্পূর্ণ বেআইনি, কেননা সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সভা-সমাবেশ হতে হবে “নিরস্ত্র“ অবস্থায়। পুলিশকে একচোখা হলে চলবে না। বিরোধী দলের ব্যাপারে গরম আবার ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপারে নরম এমনটি মোটেই কাম্য নয়। আইন সবার জন্য সমান। লাঠি বহনকারী ব্যক্তিদের এবং লগি-বৈঠা বহনকারী ব্যক্তিদের ব্যাপারে আইনের ফুল ফোর্স প্রয়োগ হতে হবে সমানভাবে ও নিরপেক্ষভাবে।
লেখক :নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।