বিপিএলের দিনকাল
প্রথম নিউজ, অনলাইন: খেলা শুরু হবে দেড়টায়। মিরপুর স্টেডিয়ামের প্রবেশপথই খুলবে দুপুর ১২টায়। তবু গতকাল সকাল ১১টা বাজার আগেই সরগরম স্টেডিয়াম-সংলগ্ন জাতীয় সুইমিংপুল এলাকা। ওখানেই যে বিপিএলের টিকিট কাউন্টার।
ট্যাব হাতে তরুণরা অনলাইনে টিকিট করে দিচ্ছে অনভ্যস্তদের। ধীর পায়ে হাঁটলেই চাপা স্বরে শোনা যাচ্ছে, টিকিট লাগবে? ফুটপাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অননুমোদিত ফ্র্যাঞ্চাইজি স্টোর এমনকি প্রিয় দল কিংবা খেলোয়াড়ের নামে প্ল্যাকার্ডের পসরাও বসেছে। মোট কথা, একটি টুর্নামেন্টের সাফল্যের শতভাগ উপাদান আছে মাঠের বাইরে, গ্যালারিতেও। কিন্তু মাঠে সেই দৈন্যতা।
পারিশ্রমিক নিয়ে থিকথিকে ‘স্ক্যান্ডাল’। গতকাল তো পাওনা না পাওয়ায় মাঠেই আসেননি দুর্বার রাজশাহীর বিদেশি ক্রিকেটাররা। বিপিএলকে ঘিরে বহির্বিশ্বের নেতিবাচক আলোচনার নতুন উপাদান যুক্ত হলো। সেই শুরুর সময় থেকে ধরলে যত দিন গেছে, তত নতুন নতুন বিতর্কের কালিমা লেগেছে বিপিএলের ভাগ্যে।
২০১২ সালে শুরু এই আসরের। নামি তারকা, ‘হাই ভোল্টেজ’ ম্যাচ দিয়ে ধুন্ধুমার শুরু হয়েছিল ঠিকই, তবে এমন একটি আসর আয়োজনের জন্য প্রস্তুত ছিল না বিসিবি। তাই প্রথমবারের নিলাম অনুষ্ঠানে টেবিলজুড়ে বসা একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের সামর্থ্য এবং সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ২০১৩ সালে সেই প্রশ্নটি প্রকাশ্যে আসে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ হয়ে। এর সঙ্গে পারিশ্রমিক ইস্যু ছিল, ছিল কোনো কোনো মালিকের বিসিবিকে প্রদেয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি না দেওয়ার ঘটনাও।
এরপর সময় গড়িয়েছে, নানা অভিযোগে বিপিএল ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে পারিশ্রমিক নিয়ে খেলোয়াড়দের এমন প্রকাশ্য প্রতিবাদ এর আগে দেখা যায়নি। আবার পারিশ্রমিক না দেওয়ার পক্ষে কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক এবারের মতো সরব সাক্ষীও দেননি।
অথচ এবারের বিপিএল হওয়ার কথা ছিল ইতিহাসের সেরা। বিসিবির নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ এমনটাই দাবি করেছিলেন। বিস্তর টাকা খরচ করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভেতরটা যে এমন ফাঁপা হবে, তা হয়তো বুঝতে পারেননি ফারুক। বুঝতে পারতেন যদি একটু সময় নিয়ে তিনি নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের আর্থিক ভিত্তিটা যাচাই করতেন। যাক, বিলম্বে হলেও তিনি এবং তাঁর পারিষদ এখন আত্মশ্লাঘায় ভুগছেন এই ভেবে যে আরেকটু সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। টুর্নামেন্টের মাঝপথে তো আর পুরনো ভুল শুধরানোর সুযোগ নেই। তাই টুর্নামেন্টের বাইলজের ফাঁকগলে গতকাল বিদেশি ছাড়াই রাজশাহীকে খেলতে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা যায়, এবার আরো অনেক ক্রিকেটারের পারিশ্রমিক বিসিবিকেই পরিশোধ করতে হবে। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের শর্তে সেটা আছে। কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি পারিশ্রমিক না দিলে ক্রিকেটারের কাছে সেই দায় সংশ্লিষ্ট বোর্ডের। অতএব খেলোয়াড়রা নিশ্চিতভাবেই পারিশ্রমিক পাবেন। তবে এই দায়মোচনের পর বিপিএল থেকে এবার বিসিবির কত লাভ হতে পারে—এমন প্রশ্ন শুনে গতকাল আঁতকে উঠেছেন এক পরিচালক, ‘লাভ? কত লস (ক্ষতি) হয়, কে জানে!’
অথচ বিপিএল শুরু থেকেই বিসিবির সোনার ডিম পাড়া হাঁস, ক্রমাগত লাভ দিয়ে গেছে। তবে সেই হাঁস পরিচর্যার অভাব আর অবহেলায় লাভের অঙ্ক কমেছে। এবার ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল। সঙ্গে আসরের ‘মানহানি’ও হয়ে গেছে।
ফারুক আহমেদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে বিপিএলের আগামী আসর জমজমাট হবে। এ জাতীয় বিতর্ক আর থাকবে না। কিন্তু কী উপায়ে বিতর্ক পেছনে ফেলে বিপিএল জনপ্রিয়তা আর আস্থার জায়গা ফিরে যাবে—সেই রোডম্যাপ এখনো অজানা।
তবে সমস্যাগুলো অজানা নয়। শুরুর আসর থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আগ পর্যন্ত বিপিএলের মূল সমস্যা ছিল ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ থেকে সৃষ্ট পক্ষপাত। কোনো কোনো বোর্ড পরিচালকের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে। তাতে আইন বদলেছে সুবিধামতো, আম্পায়াররাও পক্ষপাত করেছেন। তাতে দেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্যবসায়ী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিপিএলে জড়াতে চাননি। তাতে প্রতি আসরেই এক-দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজির লেনদেনে নজর ছিল সবার। এবার একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের আয়ের উৎস, বিশেষ করে অন্যূন ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি দল পরিচালনার সামর্থ্য আছে কি না—সেটি নিয়ে কৌতূহল ছিল এবং আছে। তবু তাঁরা দল কিনেছেন, কুড়িয়ে বাড়িয়ে পরিচালনা করছেন। কিন্তু কতটা কি পারছেন—সে তো এখন দিবালোকের মতো সত্য, যা ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য চরম বিব্রতকর।
অবশ্য মানুষ ভুল থেকেই শেখে। বিপিএলেরও সুযোগ আছে ভুলের ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। তার জন্য সবচেয়ে দরকার সদিচ্ছা এবং ধৈর্য। ধৈর্যের প্রসঙ্গটাই শুরুতে রাখতে হবে। বিপিএল যে রকম ইমেজ সংকটে ভুগছে, তা ধুয়েমুছে সাফ করতে বিস্তর সময় লাগবে। তেমনি সময় নিয়ে বিপিএল পুনর্গঠন করা জরুরি। জানুয়ারিতে আসরটি হবে ভেবে নভেম্বরে বিপিএল নিয়ে হম্বিতম্বি করলে হবে না। ফ্র্যাঞ্চাইজিকে দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তির প্রস্তাব দিতে হবে। সেই সঙ্গে আশ্বাসও দিতে হবে যে পক্ষপাতের শিকার তারা হবে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি ফর সঙ্গে ব্যাংক গ্যারান্টি আদায় করুন, তাতে পারিশ্রমিক নিয়ে ভেবে ঘামতে হবে না বিসিবিকে। তবে সঙ্গে টিভি স্বত্ব, টিকিট থেকে আয়ের লভ্যাংশ দিন ফ্র্যাঞ্চাইজিকে। লভ্যাংশ ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করবেন কেন?
তার পরও সময় লাগবে। সংস্কারে সময় তো লাগবেই।