তিন বিমানবন্দর নির্মাণে অনিয়ম: তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুদকের ৪ মামলা

তিন বিমানবন্দর নির্মাণে অনিয়ম: তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুদকের ৪ মামলা

প্রথম নিউজ, অনলাইন: দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিককের বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলায় বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিবুল হক এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমানসহ ১৯ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। সোমবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ এসব মামলা করা হয়েছে বলে কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্প্রসারণ (থার্ড টার্মিনাল) প্রকল্পের ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনকে আসামিরা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করেছেন দুদকের উপপরিচালক সালাহউদ্দিন। 

আসামিরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হক,বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো: আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান। এছাড়া স্থানীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালের মালিক লুৎফুল্লাহ মাজেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব আনাম, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্প্রসারণ (থার্ড টার্মিনাল) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এ কে এম মাকসুদুল ইসলাম ও সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (থার্ড টার্মিনাল) প্রকল্পের কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয় এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) নামীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে। উক্ত কাজের সাথেও সাব কন্ট্রাক্টর হিসাবে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালকে সম্পৃক্ত করা হয়। দুদকের অনুসন্ধানের কথা জানিয়ে মামলায় বলা হয়, ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলন প্রকল্পে অর্থের পরিমান বৃদ্ধি করে ২১ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এ প্রকল্প থেকে ক্রয় সংক্রান্ত বিধি-বিধান লংঘন করে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান করে বেআইনিভাবে স্থানীয় এজেন্ট অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে উক্ত কাজে সম্পৃক্ত করে পরস্পর যোগসাজশে প্রকল্প থেকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়ার দায়ের করা আরেক মামলায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রাডার নির্মাণ প্রকল্প কাজে ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।  এ মামলাতেও তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হকসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যান্য আসামিরা হলেন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান,সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান, সিএনএস মেইনটেনেন্স বিভাগের পরিচালক আফরোজা নাসরিন সুলতানা, পরিচালক (পরিকল্পনা) এ কে এম মনজুর আহমেদ। এছাড়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালের মালিক লুৎফুল্লাহ মাজেদ ও এমডি মাহবুব আনামকে আসামি করা হয়েছেন। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের Installation of RADAR with CNS – ATM (Communication, Navigation and Surveillance - Air Traffic Management  শিরোনামে রাডার নির্মান কাজে অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালকে সম্পৃক্ত করা হয়। প্রকল্পের কাজে সর্বশেষ হিসাব অনুসারে ব্যয় করা হয়েছে ৭৩০ কোটি টাকা; যা বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়। যার মধ্যে পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান করে বেআইনীভাবে স্থানীয় এজেন্ট অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে ব্যবহার করে ওই প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাত করেন আসামিরা।

দুদক সহকারী পরিচালক এস এম রাশেদুল হাসানের দায়ের করা মামলায় কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের টার্মিনাল নির্মান কাজ ও রানওয়ে নির্মান কাজে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।  এতে আসামি করা হয়েছে ১০ জনকে। তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হক,বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান,সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো: আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো: হাবিবুর রহমান। এছাড়া অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালের মালিক লুৎফুল্লাহ মাজেদ,এমডি মাহবুব আনাম,বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মোঃ শফিকুল ইসলাম এবং কক্সবাজার বিমান বন্দর উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়-৪র্থ সংশোধিত) প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. ইউনুস ভূইয়া।

এজাহারে আরও বলা হয়, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের টার্মিনাল নির্মান কাজ ও রানওয়ে নির্মান সংক্রান্ত প্রকল্পের কাজে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি) নামীয় একটি চায়না কোম্পানিকে প্রকল্পের কাজে কার্যাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ অন্যান্যরা প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন।

ওই প্রকল্পের কাজে প্রচলিত ক্রয় প্রক্রিয়ার বিদ্যমান বিধান লঙ্ঘন কর অর্থছাড়করণ সংক্রান্ত বিধান ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান করে বেআইনিভাবে স্থানীয় এজেন্ট অ্যরনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সঙ্গে  যোগসাজশে প্রকল্প হতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। 

অপর আরেক মামলায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের দুই হাজার কোটি টাকার নতুন টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ না করে অগ্রিম বিল হিসেবে ২১২ কোটি টাকা ছাড় করার অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। মামলাটি দায়ের করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর । এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. মুহিবুল হকসহ অন্যান্যদের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান,বেবিচকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হাবিবুর রহমান আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল আনাম, পরিচালক লুৎফুল্লাহ মাজেদ, প্রকল্প পরিচালক মইদুর রহমান মো. মওদুদ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব শাহ জুলফিকার হায়দার (বর্তমানে উপ সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়) এবং সাবেক যুগ্মসচিব  মো. আনিছুর রহমানকে (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) আসামি করা হয়েছে।

আসামিদের বিরুদ্ধে এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রকল্পের কাজে প্রচলিত ক্রয় প্রক্রিয়ার বিদ্যমান বিধান লঙ্ঘন করে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক এখতিয়ার লংঘনপূর্বক ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যয়মঞ্জুরী, পরিদর্শন, অর্থ ছাড়করণ সংক্রান্ত বিধান ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অবৈধ সুবিধা দেওয়া ও নেওয়া হয়েছে। আইন, চুক্তি ও প্রচলিত বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে পরস্পর যোগসাজশে এ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্পের কাজে ২১২ কোটি টাকা অগ্রিম বিল নেওয়া হয়। অগ্রিম বিল নেওয়ার পর এ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনাল কাজ বন্ধ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা আত্মগোপনে রয়েছে বলেও এজাহারে বলা।

আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১২০/১৬১/১৬৩/১৬৪/৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।