অপরাধের অভয়ারণ্য রাতের তিনশ ফুট
প্রথম নিউজ, অনলাইন: রাজধানীর পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে (তিনশ ফুট সড়ক) এলাকায় রাতের মায়াবী দৃশ্য রীতিমতো বিমোহিত করে নগরবাসীকে। তাই যান্ত্রিক কোলাহল থেকে কিছুটা মানসিক প্রশান্তি পেতে অনেকেই চলে যান পূর্বাচলের এই সড়কে। তবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার এ এলাকা এখন অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে ঘটছে গতির প্রতিযোগিতা, মাদকসেবন, ছিনতাই, ইভটিজিং এবং লাশ গুমের মতো নানা অপরাধও। সরেজমিন তিনশ ফুট রোড এবং পূর্বাচল এলাকা ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, বাসিন্দা এবং ঘুরতে আসা লোকজন তাদের দুর্ভোগ ও নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন /
সোমবার রাতে সরেজমিন ঘুরে তিনশ ফুট এলাকায় ঘুরতে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের বহুবিধ দুর্ভোগ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা। এছাড়া এলাকাবাসী দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন।
রাত সাড়ে ৮টা। রাজধানীর ৩০০ ফুট সড়কের বোয়ালিয়া এলাকায় রাস্তার পাশে মোটরসাইকেল থামিয়ে বসে পড়েছে দুই তরুণ-তরুণী। মোটরসাইকেলের আড়ালে বসে তাদের ইয়াবাসেবন করতে দেখা গেল। রাত ৮টা ১০ মিনিটে দুটি মোটরসাইকেলে দ্রুতবেগে নীলা মার্কেটের দিকে ছুটতে দেখা যায় চার তরুণ-তরুণীকে। এর প্রায় ১০ মিনিট পর আশিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন ইউটার্নের নিচে সড়কের দিকে জটলা পাকিয়ে তরুণ-তরুণীরা মাদকসেবন করতে দেখা যায়।
রাত সাড়ে ১০টায় নীলা মার্কেটের বিপরীতে বুরলিয়া চত্বরে শাকিলা পিঠাঘরের মালিক শাকিলা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, রাত ৩টা পর্যন্ত জেগে থাকে এই এলাকা। দূর-দূরান্ত থেকে তরুণ-তরুণীরা ঘুরতে আসেন এখানে। কেউ টিকটক করেন, কেউ করেন ফুড রিভিউ। শাকিলার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ এলাকায় আগেও অপরাধ ছিল; কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততায় অপরাধের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। তিনি জানান, এ এলাকার নির্জন স্থানগুলোয় মাদকসেবন, ইভটিজিং, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। তাছাড়া সড়কে চলাফেরা অনেকটাই অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। নেশায় বুঁদ হয়ে সাঁইসাঁই করে মোটরসাইকেল চালায় একশ্রেণির বখাটে তরুণরা। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। রাত সাড়ে ১০টায় নীলা মার্কেটে সুস্বাদু মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় ভোলানাথপুরের আব্দুল আজিজের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ এলাকার রাতবিরাতের অবস্থা খুবই খারাপ। বাইরে থেকে ঘুরতে আসা লোকজন প্রায়ই অপরাধীদের খপ্পরে পড়েন। তাদের ব্যাগ, মোবাইল ফোন ছিনতাই করে মোটরসাইকেল কিংবা প্রাইভেট কারযোগে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তিনি বলেন, আগে পূর্বাচল এলাকায় স্থানীয়দের বসতি ছিল। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা কারণে অনেকেই এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এখন যারা বিভিন্ন এলাকায় ঘরবাড়ি করে বসবাস করছেন, তাদেরকে প্রায়ই চুরি-ডাকাতির সম্মুখীন হতে হয়।
সুস্বাদু মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিনথিয়া। তিনি বলেন, এ এলাকায় রাতে বখাটে ও মাদকাসক্তদের উৎপাত বেড়ে যায়। এদের দ্বারা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয় তরুণীদের। নীলা মার্কেট এলাকায় কথা হয় মাস্তুল এলাকার কাঁচামাল ব্যবসায়ী আজাদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনশ ফুট সড়কে যানবাহনের চাপ কমে। আর ফাঁকা সড়কে বাইকাররা দল বেঁধে গতির খেলায় মত্ত হয়। শুধু বাইক না, কার রেসিংও চলে সড়কে। নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় সময়ই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটে প্রাণহানি।
এ সময় আরও একাধিক ব্যক্তি যুগান্তরকে বলেন, রাতে সড়কটিতে দ্রুতগতিতে স্পোর্টস কার রেসিং করে অভিজাত ঘরের ছেলেমেয়েরা। এছাড়া অত্যাধুনিক মডেলের মোটরসাইকেল বা স্পোর্টস মোটরসাইকেল দিয়েও অনেকে দল বেঁধে গতির লড়াই করে। এরা গাড়িতে বসেই মাদকসেবন করে।
নীলা মার্কেট এলাকায় চেকপোস্টে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্য বলেন, তরুণদের বেপরোয়া চলাচল কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ রাখা যাচ্ছে না। প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা হয় এসব তরুণের।
তিনশ ফুটে খিলক্ষেত থানা পুলিশের একটি চেকপোস্টে দায়িত্বরত এসআই মুখলেসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যারা বিভিন্ন অপরাধ ও বেপরোয়া গতির সঙ্গে জড়িত, তাদের অধিকাংশই রাতে মাদকাসক্ত থাকে। তিনি বলেন, আমরা যথাসাধ্য দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় জনবল কম থাকায় আমাদের ব্যর্থ হতে হয়। তিনি জানান, এ সড়কে দামি দামি প্রাইভেট কারে করে দিনে ঢুকে মাদকের চালান। আর রাতে মূলত টিকটকার, মাদকসেবীসহ বিভিন্ন শ্রেণির তরুণ-তরুণীরা এ সড়ক দিয়ে নীলা মার্কেট এলাকায় ঘুরতে যায়।
১৯ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে পূর্বাচল তিনশ ফুট (কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বালু নদ পর্যন্ত পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে) নীলা মার্কেট এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের আরোহী বুয়েট শিক্ষার্থী মুহতাসিম নিহত হন। গুরুতর আহত হন বুয়েটের আরও দুই শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান ও অমিত সাহা। তারা সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় প্রাইভেট কারচালক মুবিন আল মামুন, মিরাজুল করিম ও আসিফ চৌধুরী নামে তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানোর কথা স্বীকার করেছে।
এর আগে ১৭ ডিসেম্বর পূর্বাচল তিনশ ফুট সড়ক এলাকার লেক থেকে কলেজছাত্রী সুজানার মৃতদেহ এবং ১৮ ডিসেম্বর একই লেক থেকে কাব্য নামে এক স্কুলছাত্রের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সুজানা ও কাব্য পরস্পর বন্ধু ছিলেন। লেক থেকে তাদের মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, ওভার স্পিডের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পূর্বাচল এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। গত এক মাসে তিন ছাত্রসহ অন্তত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সড়কেও ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের তথ্যমতে, এক বছরে ২২টি মৃতদেহ পাওয়া গেছে পূর্বাচলের বিভিন্ন এলাকায়। বিভিন্ন সেক্টর ও সড়কের পাশ থেকে মিলেছে মরদেহগুলো। এসব মরদেহের মধ্যে কোনোটি খণ্ডিত, কোনোটি আবার গুলিবিদ্ধ কিংবা গলা কাটা। নীলা মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মানুষকে অন্য স্থানে হত্যা করে এদিকে নিয়ে এসে নির্জন জায়গায় ফেলে রেখে যায়। এজন্য মানুষ অনেক ভয় পায়। সন্ধ্যার পর সব লোক ভেতর থেকে চলে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পূর্বাচলের বিভিন্ন সেক্টরের খালি বিভিন্ন প্লটে গড়ে উঠেছে কিছু অবৈধ স্থাপনা। রাত নামলে সেগুলোয় আলো জ্বললেও অন্যান্য জায়গায় থাকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ঘটে অনৈতিক কার্যকলাপসহ নানা অপরাধ।
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী বলেন, তিনশ ফুটে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। চেকপোস্টের পাশাপাশি টহল জোরদার করা হয়েছে। আমি নিজেও রাতে এসব এলাকায় যাই। মঙ্গলবার মধ্যরাতে নীলা মার্কেট এলাকায় ১০-১২ জনকে রেসিংয়ের প্রস্তুতি নিতে দেখে আমরা তাদের থামিয়ে দিই। ওসি বলেন, সেক্টরগুলো রোড থেকে অনেক ভেতরে হওয়ায় এবং ওখানে যেহেতু জনবসতি কম, রাতে বিদ্যুতের পর্যাপ্ত আলোও থাকে না। এই সুযোগে দূরে কোথাও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অপরাধীরা আলামত এনে এখানে রেখে যায়। দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের সহায়তায় যৌথভাবে তল্লাশি করা হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, তিনশ ফুটে ওভার স্পিডিং বেশি হয়। সন্ধ্যার পর গাড়ি কমে যাওয়ায় বাড়ে যানবাহনের গতি। দ্রুতগতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে স্পিড ক্যামেরা বসিয়ে স্পিড নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।