উল্টো পথে দেশের অর্থনীতি

উল্টো পথে দেশের অর্থনীতি

প্রথম নিউজ, অনলাইন: অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ছয় মাসেও সঠিক পথ খুঁজে পায়নি দেশের অর্থনীতি। রপ্তানি খাত ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখনো দুই অঙ্কের ঘরে। ব্যাংক ঋণ ও এলসি সমস্যায় একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বেকার হচ্ছে কর্মজীবী শ্রমিক। প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সহায়তা মিলছে না। বন্ধ রয়েছে ছোটবড় প্রকল্পের কাজ। আসছে না নতুন প্রকল্প।
দেশিবিদেশি বিনিয়োগও কমছে। নানামুখী সংকটে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা। সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি এখন উল্টো পথে চলছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল মুজেরি বলেন, বিগত সরকারের তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অর্থনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বরং ৫ আগস্টের পর নীতি গ্রহণে প্রচুর দুর্বলতা চোখে পড়েছে। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও স্পষ্ট হয়ে পড়ছে। ফলে অর্থনীতির যে সূচকগুলোর ধীর গতি ছিল, তা এখন স্থবির হয়ে পড়েছে।

এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামষ্টিক অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে আগামী বাজেটের হিসাব-নিকাশ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে রাজস্ব আয়ের ঘাটতি এবং প্রত্যাশিত বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ায় সরকারের মধ্যে শঙ্কা বাড়ছে।
এই শঙ্কা কাটাতে চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে ভ্যাট বাড়ানোর মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে গণচাপে সেই সিদ্ধান্তও সংশোধন করতে হয়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে আর্থিক বিশৃঙ্খলা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের এই শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি আগের মাস নভেম্বরের তুলনায় কিছুটা কমলেও এটি এখনো দুই অঙ্কের ঘরে রয়ে গেছে। গত মাসের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বাড়তি মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়ানোর দিকেই ঝুঁকছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। তবে ঋণের সুদহার বাড়লে তা বেসরকারি খাতের সংকট আরও বাড়িয়ে দেবে বলে জানিয়েছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।

মিলছে না প্রত্যাশিত বৈদেশিক সহায়তা : অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া গেছে ৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কম। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে ৪ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল।

রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি : শুধু যে বৈদেশিক সহায়তা কমেছে তাই নয়, সরকারের রাজস্ব আয়ও কমছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা কম।

কমছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ : সরকারের আয়ের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও কমে গেছে। এমনকি রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতেও কমছে বিনিয়োগ। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান জানান, বৈশ্বিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ নানা কারণে গত ছয় মাসে ইপিজেডগুলোতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ শতাংশ কমেছে। প্রায় একই হারে রপ্তানি বেড়েছে।

জানা গেছে, পানিসংকটের কারণে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে সাড়ে ১৩ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ চলে গেছে। এ ছাড়া জ্বালানিসংকটকে বিনিয়োগের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখছে বেপজা। বিদেশি বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগও কমছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বর মেয়াদে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তিও কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছে। গত নভেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বেসরকারি খাতের ঋনের প্রবৃদ্ধি ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমার অর্থই হচ্ছে দেশে শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। - বাংলাদেশ প্রতিদিন