পাথর আমদানিতে টিকে আছে নাকুগাঁও স্থলবন্দর

পাথর আমদানিতে টিকে আছে নাকুগাঁও স্থলবন্দর

প্রথম নিউজ , শেরপুর: বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ডলার সংকটে ২০২১-২২ অর্থ বছরের তুলনায় ২২-২৩ অর্থবছরে শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দরে আয় কমেছে দুই কোটি ৬১ লাখ টাকা। চাহিদা মোতাবেক এলসি করতে না পারা ও ব্যাংকে ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে কমেছে পণ্য আমদানি। পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হওয়ার পর ১৮টি পণ্য আমদানির কথা থাকলেও শুধু পাথর আমদানি চলছে এই বন্দরে। এতে বন্দরের আয় যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে সরকারের রাজস্ব আদায়ও।

বন্দরে শুধু পাথর আমদানি কার্যক্রম চলায় একদিকে নতুন ব্যবসায়ীর দেখা মিলছে না, অন্যদিকে আগ্রহ হারাচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। এছাড়া বৈশ্বিক মন্দাভাব ও ডলার সংকটের কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের আয় কমেছে দুই কোটি ৬১লাখ টাকা। গেলো অর্থবছরে ৬৩ হাজার মেট্রিক টন পণ্য কম আমদানি হয়েছে। ২১-২২ অর্থ বছরে ৪১ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হলেও ২২-২৩ অর্থ বছরে পণ্য আমদানি হয়েছে মাত্র ২৯ কোটি টাকার।

নাকুগাঁও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বন্দর দিয়ে ৫৮ হাজার ৮১৬ মেট্রিক টন ভূটানের পাথর, ২ লাখ ৭ হাজার ৯৮৬ মেট্রিক টন ভারতের পাথর ও ৯ হাজার ৩৯৩ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। যার আনুমানিক মূল্য ছিল ৪০ কোটি ৯৯ লাখ ৪ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বন্দর মাশুল ও ভ্যাটসহ নাকুগাঁও স্থলবন্দরের আয় ছিল ৩ কোটি ৩২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৭ টাকা এবং কাস্টমসে রাজস্ব জমা পড়ে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

অপরদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৭ হাজার ১৯৩ মেট্রিক টন ভূটানের পাথর, ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫৮৫ মেট্রিক টন ভারতের পাথর, ১ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন কয়লা এবং ১১ মেট্রিক টন আদা আমদানি করেছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। যার আনুমানিক মূল্য ২৮ কোটি ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। বন্দর মাশুল ও ভ্যাটসহ স্থলবন্দরের আয় ২ কোটি ৬১ লাখ ৬ হাজার ৫২ টাকা এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বন্দরের আয় কমেছে ৭১ লাখ ৫৭ হাজার ৯৯৫ টাকা এবং কাস্টমসের রাজস্ব কমেছে ১৬ লাখ ১ হাজার টাকা।

৩৩ বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৯৭ সালে দেশের উত্তর সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টসহ বন্দরটি প্রথমে স্থলশুল্ক বন্দর হিসেবে চালু হয়। কয়লা আমদানির মধ্য দিয়ে এই বন্দর বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। কিন্তু ২০০২ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ বন্দর দিয়ে কয়লা ও পাথর ছাড়া সব পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০৯ সালের ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বন্দরটি পরিদর্শন করে এটিকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে চালুর ঘোষণা দেন। এরপর ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি নাকুগাঁও এলাকায় পূর্ণাঙ্গ বন্দরের অবকাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

সম্ভাবনাময় এ বন্দরটিকে ২০১৫ সালে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাড়ে ১৩ একর জমির ওপর প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় ওয়্যার হাউস, কাস্টমস ভবনসহ অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন কাজ। যোগাযোগ সহজ করতে আড়াইশো কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ২৯ কিলোমিটার প্রশস্ত পাকা সড়ক। আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় পাথর ও কয়লাসহ প্রচলিত ও অপ্রচলিত ১৮টি পণ্যের।

তবে দীর্ঘ আট বছরে বন্দরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের সুবিধা পাচ্ছেন না এখানকার আমদানিকারকরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু পাথর সরবরাহে আটকে থাকলে অচল হয়ে পড়বে নাকুগাঁও স্থলবন্দর। বন্দরের ওপারেই মেঘালয় রাজ্য থেকে শুঁটকি মাছ, খৈল, সুপারি ও পশুখাদ্য আমদানি শুরুর দাবি জানিয়েছেন তারা।

নাকুগাঁও স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল বলেন, ব্যবসা বাড়াতে আমদানির পাশাপাশি চাহিদা মোতাবেক পণ্য রপ্তানি শুরু করতে পারলে পাল্টে যাবে এখানকার চিত্র। তবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ভারতের কাস্টমস জটিলতায় তা এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া অনুমোদিত সব পণ্য আমদানিও করা যাচ্ছে না। কারণ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের নাকুগাঁও কেন্দ্রিক ব্যবসা বাড়ানোর আগ্রহ খুবই কম। আমরা এনবিআরের কাছে বারবার আবেদন করেও অনুমোদিত পণ্য সরবরাহের সুযোগ পাচ্ছি না।

তিনি বলেন, গেলো অর্থবছরে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও সময়মতো ডলার না পাওয়ায় এলসি না করতে পেরে পণ্য আমদানি সম্ভব হয়নি। তাই এবার বন্দরের আয় কমেছে। স্থলবন্দরের কার্যক্রম আরও বেগবান করার জন্য সম্প্রতি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল স্থলবন্দরটি পরিদর্শন করেছেন। ব্যবসা বাড়াতে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

এদিকে ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ও অনুমতি নিয়ে বন্দরকে আরও গতিশীল করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নাকুগাঁও স্থলবন্দর কর্মকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, আমরা আমাদের সর্বচ্চো চেষ্টা করছি। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের আরও আন্তরিকতা বাড়াতে হবে। নতুন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের যুক্ত করতে পারলে এখানে আরও ব্যবসা বাড়বে।

নাকুগাঁও কাস্টমস রেভিনিউ অফিসার শহিদুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক মন্দাভাব ও ডলারের দাম বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়ীরা ঠিকভাবে এলসি করতে পারেননি। তাই পণ্য কেনার সুযোগ হয়নি তাদের। গত অর্থবছরের শেষের দিকে জানুয়ারি থেকে পণ্য আমদানি বেড়েছে। তবে অর্থবছরের সার্বিক চিত্র গতবারের চেয়ে কম। আশা করছি পরবর্তী অর্থবছরে এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। আমরা এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।