‘কী আর করমু, কপালে আছে তাই পুকুরের ওপর মাচা বানাইয়া থাহি’

মিনারা বেগম, বয়স ৫০। ১৫ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন তিনি।

‘কী আর করমু, কপালে আছে তাই পুকুরের ওপর মাচা বানাইয়া থাহি’

প্রথম নিউজ, ঝালকাঠি: মিনারা বেগম, বয়স ৫০। ১৫ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন তিনি। স্বামীর চিকিৎসা করতে গিয়ে শেষ করেছেন সহায় সম্বল। নিঃস্ব হয়ে নানাবাড়িতে মায়ের জমিতে ঘর তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মামাতো ভাইদের চাপে তা সম্ভব হয়নি। মায়ের জায়গা পেয়েছেন পুকুরের ওপর। নিরুপায় হয়ে সেখানেই বাঁশের খুঁটি দিয়ে বানিয়েছেন মাচা। পলিথিন আর পাটির ছাউনিতে ঢেকে নাতিকে নিয়ে দিনপার করছেন সেখানেই।

মিনারা বেগমের বিয়ে হয়েছিল ফরিদপুরে। তার বাবাবাড়ি নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের রাজপাশা গ্রামে। নলছিটি পৌরসভার সবুজবাগ এলাকায় নানাবাড়িতে পুকুরের ওপর বাঁশের খুঁটি দিয়ে মাচা তৈরি করে পলিথিন দিয়ে দীর্ঘ তিনমাস ধরে বসবাস করছেন মিনারা বেগম ও তার নাতি নিরব সরদার।

মিনারা বেগম বলেন, স্বামী মইরা গেছে ১৫ বছর হইছে। আমার একটা নাতি আছে, ও আমার লগে থাকে। নাতিরে লইয়া অনেক কষ্টে দিনযাপন করছি। একটা বাসা ভাড়া নিছিলাম হেয়াও পানিতে তলাইয়া যায়। আয় রোজগারের কেউ না থাহায় ভাড়া দিতে পারিনি। এর আগে আমার ভাই বাসা ভাড়ার টাকা দিতো তিনি এখন দেওয়া বন্ধ করে দিছেন। এহন কই যামু, যাওয়ার কোনো পথ দেহি না। পরে চিন্তা করলাম সবার কাছে চাইয়া বাঁশ আইনা পুহোইরের (পুকুর) মধ্যে মাচা বানাইয়া থাহি।

তিনি আরও বলেন, মোর মায়ে জায়গা পাইবো মামাবাড়ি। জায়গাটার জন্য তিনবছর ধরে মামাতো ভাইগো কাছে ঘুরতে আছি। কিন্তু এরপরও আমারে ঘর বানাইতে দেয় নাই। যখন তাদের কাছে গেছি আমারে ধাক্কা মাইরা ফালাইয়া দিছে। আরেক মামাতো ভাই সিদ্দিকুর রহমান পুকুরের মধ্যে জায়গা নিতে কয়। আমি কী আর করমু, কপালে আছে তাই পুকুরের ওপর বাঁশের খুঁটি দিয়া মাচা বানাইয়া তিনমাস ধরে নাতিরে লইয়া থাহি।

আক্ষেপ করে মিনারা বেগম বলেন, আমার কোনো ছেলে নাই। একটা মেয়ে আছে তার স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়েছে। মেয়ে এখন চট্টগ্রাম থাকে। আমি তিনবছর হয়েছে নলছিটিতে এসেছি। মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোনো কিছুই পাইনি। সরকারি ঘরের জন্য দুবার আবেদন করেছি তাও কপালে জোটেনি। বিধবা ভাতার জন্য গেছি জানিয়েছে কোটা খালি নাই।

তিনি বলেন, আমার নাতি নলছিটি মার্চেন্টস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। অনেক কান্নাকাটি করে ঘর নাই এভাবে থাকা যায় না। পড়াশোনা করতে কষ্ট অয়। ও যে চট্টগ্রাম গিয়ে পড়াশোনা করবে তার মায়ের কাছে সেখানেও অনেক খরচ। এহন যদি কেউ আমারে সাহায্য সহযোগিতা বা থাকার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে নাতিটারে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারি।

নলছিটি পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মনিরুজ্জামান মনির বলেন, বিধবা ওই নারী তার নাতিকে নিয়ে তিনমাস ধরে বাঁশের খুঁটি দিয়ে মাচা বানিয়ে পলিথিনের ছাউনিতে ঢেকে পুকুরের ওপর থাকছেন। মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে বসবাস করছে তা বলে বুঝাতে পারবো না। আমার কাছে এলে আমি ফেসবুক লাইভ দিলে বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। ঢাকার জসিম ভাই নামে এক সাংবাদিক তাদের জন্য টিন কিনে দিয়েছেন। আসলে তার দরকার থাকার মতো একটা ঘর।

এ বিষয়ে জানতে মিনারা বেগমের মামাতো ভাইদের বাড়িতে না পাওয়ায় তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। নলছিটি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, মিনারা বেগমের জাতীয় পরিচয় পত্র দেখে যদি ভাতা পাওয়ার প্রাপ্য হন তাহলে অবশ্যই আওতায় আনা হবে।

নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, মিনারা বেগমের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি সরেজমিনে তার অবস্থা দেখবো। আর তার জন্য সরকারি সহায়তা করা হবে।