স্বাস্থ্যে দুর্নীতি: পদ নেই, পদায়ন আছে
অধিদফতরের প্রশাসনিক বিভাগের একটি চক্র এসব পদে বদলি ও পদায়ন করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে
প্রথম নিউজ, ঢাকা: উপজেলার ৩১ শয্যা হাসপাতালের বিলুপ্ত হওয়া পদে পদায়ন ও বদলি করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কিছু অসাধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কৌশলে এসব বিলুপ্ত পদে পদায়ন ও বদলি করে অর্থ আত্মসাৎ করছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের উপজেলাগুলোর ৩১ শয্যার পুরনো হাসপাতালের বেশকিছু পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু অধিদফতরের প্রশাসনিক বিভাগের একটি চক্র এসব পদে বদলি ও পদায়ন করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। যাদের সঙ্গে অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন)-এর একজন ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিলুপ্ত পদ: ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় (স্মারক নম্বর- ৪৫.০০/০০০০.১৪৫.১৫.০৯৯.১৬-৩৩) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, যে সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হবে, সেসকল ৩১ শয্যা হাসপাতালের-মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব), চিকিৎসা সহকারী, প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষক, সহকারী নার্স, ফার্মাসিস্ট, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, পরিসংখ্যানবিদ ও জুনিয়ার মেকানিক পদ বিলুপ্ত করা হয়। কারণ ৫০ শয্যা হাসপাতালে সৃষ্ট পদে নতুন জনবল নেওয়া হবে।
একই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৩১ শয্যা হাসপাতালে কর্মরত এসব জনবলের চাকরি থেকে অবসর, ইস্তফা, বরখাস্ত, মৃত্যু এবং বদলিজনিত কারণে পদগুলো শূন্য হলে এসব পদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে।
বিলুপ্ত পদে যেভাবে পদায়ন: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই আদেশ ও প্রজ্ঞাপন মানছে না স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসন বিভাগের চক্রটি। বরগুনা জেলার আমতলী ৫০ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষক শংকর চন্দ্র গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসর নেন। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তার পদটি বিলুপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি অবসরে যাওয়ার চার দিন আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি চক্র একই হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম মন্টুকে প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষক পদে পদোন্নতি দেয়।
একইভাবে ভান্ডারিয়া ৫০ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত মো. সোহেলকে গত ৫ মে (স্মারক নং ১৯৯৭) বদলি করে আমুয়া (কাঁঠালিয়া) ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষকের শূন্যপদে। যদিও ৫০ শয্যা হাসপাতালে এমন কোনও পদ নেই।
ভান্ডারিয়া ৫০ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ক্যাশিয়ার মো. আল মামুনকে গত ৬ মে (স্মারক নং ২০৩৬) পদোন্নতি দিয়ে একই হাসপাতালের প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষকের শূন্যপদে পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা দেশেই এসব বিলুপ্ত পদে পদায়ন দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের (প্রশাসন) ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) আহসান সাইদ এরশাদের যোগসাজসেই মিলছে এসব পদোন্নতি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সিন্ডিকেট খেয়াল রাখে—৩১ থেকে ৫০ শয্যা হওয়া হাসপাতালগুলোর বিলুপ্ত পদগুলো থেকে কে কখন অবসরে যাচ্ছেন। কেউ অবসরে যাওয়ার ঠিক তিন-চারদিন বা এক সপ্তাহ আগে এসব পদে অন্য কাউকে বদলি বা পদায়ন করে তারা। পদটি হাসপাতাল থেকে বিলুপ্ত হতে দেয় না। এর বিনিময়ে ২-৩ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
আহসান সাইদ এরশাদ নিজে একজন স্বাস্থ্য সহকারী থেকে অবৈধ উপায়ে পদোন্নতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রেষণে কর্মরত। সদ্যবিদায়ী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমামের আস্থাভাজন হওয়ায় এরশাদ স্বাস্থ্য অধিদফতরে তার নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সারাদেশেই এমন বদলি ও অবৈধ পদোন্নতির বাণিজ্য করছেন।
অভিযুক্ত এরশাদের বিরুদ্ধে অবৈধ পদোন্নোতি দিয়ে সম্পদ অর্জনসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে দুদকে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলা ট্রিবিউনে ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরে অবৈধ পদোন্নতির হিড়িক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যার পরপরই প্রশাসন শাখার পরিচালক ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমামকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে এখনও বহাল রয়েছেন তার সহকারী এরশাদ।
এ বিষয়ে এরশাদের কাছে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন শুনেই ফোন কেটে দেন। বারবার চেষ্টা করেও তার আর মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
৫০ শয্যার ১৫৮ এবং ৩১ শয্যার ২৬৬টি হাসপাতাল: দেশের ১৫৮টি উপজেলায় ৫০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। অপরদিকে ২৬৬টি উপজেলায় এখনও ৩১ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। উপজেলাগুলোর জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার জন্য পর্যায়ক্রমে ৩১ শয্যার হাসপাতালগুলোকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী কাজও চলছে। এজন্য ৫০ শয্যার জনবল কাঠামোও তৈরি করা হয়েছে। যেসব উপজেলার হাসপাতাল ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে সেখানে ৩১ শয্যা হাসপাতালে কর্মরত পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে।
অধিদফতর যা বলছে: স্বাস্থ্য অধিদফতরের বর্তমান পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি প্রশাসনিক পদে এসেছি একমাসেরও কম সময়ে। এখনও এসব পদে পদায়ন ও বদলি দেইনি। এগুলো আগেই হয়েছে, কেন তারা এসব করেছে তারাই বলতে পারবে। চেষ্টা করছি প্রশাসনিক কাঠামো ঠিক করার। আশা করছি শিগগিরই সব ঠিক করতে পারবো।’
তিনি বলেন, ‘৫০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার পর ৩১ শয্যা হাসপাতালের কিছু পদ বিলুপ্ত হয়েছে। তবে জনবল কম থাকায় যে যেখানে রয়েছেন, তাকে সেভাবেই রাখা হয়েছে। এই পদে বদলি ও পদায়ন বন্ধ থাকবে।’
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: