ভারতবর্ষে আলেক্সান্ডার : স্বপ্ন, সংঘাত ও সীমান্ত

প্রথম নিউজ, অনলাইন: ইংল্যান্ডের স্টোক সিটি নিয়ে একটা প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে। আপনি দুনিয়ার যেখানে যা-ই করেন না কেন, ব্রিটানিয়া স্টেডিয়ামের ঠাণ্ডা বৃষ্টিস্নাত রাতে যদি কিছু করতে না পারেন, তাহলে নাকি লাভ নাই। লিওনেল মেসি যখন ৫টা ব্যালন জিতলেন, তখনো বলা হতো—তিনি বিশ্ব জয় করতে পারেন, কিন্তু স্টোক সিটিতে গিয়ে তো আর গোল করেন নাই। তাহলে আবার কিসের শ্রেষ্ঠত্ব!
মেসি সেই ‘কোল্ড উইন্ডি নাইট’-এর মুখোমুখি হলে কী করতেন, তা আমরা জানি না।
কিন্তু যুগে যুগে আমরা প্রতিপক্ষের সীমানায় ভৌগোলিক প্রতিকূলতার সামনে অনেক তাবড়-তাবড় যোদ্ধাকে লুটিয়ে পড়তে দেখেছি।
যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে আবহাওয়া যে কতবড় ভূমিকা রাখে, তা নেপোলিয়নের চেয়ে ভাল কেউ বোধহয় জানে না। রাশিয়ার তীব্র শীতে নেপোলিয়নের গ্ল্যান্ড আর্মি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলের গেরিলা আক্রমণের মুখে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েছিল তারা।
মিসর অভিযানের সময় তো ধূ ধূ মরুর প্রান্তরে মরতে বসেছিল ফ্রেঞ্চ আর্মি।
ভারতবর্ষও কম প্রতিকূল না। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট যখন ভারতবর্ষের মাটিতে পা রেখেছিলেন, তখন তাকে স্বাগত জানিয়েছিল আর্দ্র আবহাওয়া, ঘন জঙ্গল আর খরস্রোতা নদী। যে কোন বহিরাগত সৈন্যদলের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
গ্রিক সভ্যতার বিশ্ববিশ্রুত এই সামরিক কমান্ডারের গল্পটা বরং আপনাদেরকে শোনানো যাক।
পারস্যে সংঘাত
মেসিডোনিয়ার বরপুত্র মাত্র ২০ বছর বয়সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন বিশ্বজয়ের উদ্দেশ্যে। সময় তখন ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রথম ধাক্কাটা আসে পারস্যের ওপর। খোদ আলেক্সান্ডারের সেনাপতিরাও বোধহয় বিশ্বাস করতেন না যে তাদের পক্ষে পারস্য দখল করা সম্ভব।
কিন্তু অনুপ্রেরণার নেওয়ার জন্যও যথেষ্ট রসদ ছিল গ্রিকদের জন্য।
রাজাদের রাজা নামে খ্যাত প্রথম দরিয়ুসের আমল থেকেই পারস্যের সাথে গ্রিকদের তীব্র দ্বন্দ্ব। সাম্রাজ্য যখন বিস্তৃত, বিদ্রোহ তখন অবধারিত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯-৯৩ সালের সময়কালে আয়োনীয় নগররাষ্ট্র (বর্তমান তুরস্কের উপকূলীয় অঞ্চল) গর্জে ওঠে পারস্যের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহের সুরে লয় যোগ করে এথেন্স।
পারস্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিদ্রোহ দমন করা হয় সফলভাবে। অতঃপর দরিয়ুসের অগ্নিদৃষ্টি গিয়ে পড়ে গ্রিসের ওপর। পুরো গ্রিসকে পারস্য সাম্রাজ্যের আওতায় আনার নীলনকশা এঁকে ফেলেন তিনি।
৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য থেকে লাখখানেক সৈন্যের এক বিশাল নৌবহর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নেমে চলে উত্তর-পূর্ব গ্রীসের ম্যারাথন উপকূলে। এথেন্সের তরফ থেকে যায় মাত্র ১০ হাজার সৈন্য।
এথেন্সের পতন তখন সন্নিকটে। কিন্তু তুরুপের তাস হয়ে গ্রিক দিগন্তে আবির্ভাব ঘটে ট্রাইরিম (Trireme) জাহাজের। বিশেষায়িত এই জাহাজের সামনের লাগানো থাকতো শক্তিশালী ব্রোঞ্জের র্যাম। ভাল নিয়ন্ত্রণ থাকলে প্রতিপক্ষের যুদ্ধজাহাজকে সূচালো র্যামের আঘাতে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলা যেত। এটাই খেলা ঘুরিয়ে দেয়। ছোট এথেন্সের সামনে শোচনীয় পরাজয় ঘটে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী পারস্যের।
যুদ্ধকৌশল
প্রাচীন গ্রীসের এক বিশেষ যুদ্ধকৌশল ছিল ফালানক্স (Phalanx)। সারিবদ্ধ সেনারা কাছাকাছি এসে ঘন বূহ্যের মতো তৈরি করবে। হাতে থাকবে ১৮ ফুট লম্বা বর্শা। সামনের দিকে তাক করা হবে সেগুলি। শত্রুপক্ষ দলবদ্ধ হয়ে ফালানক্সের সামনে চলে এলে আর রক্ষে নেই। আলেক্সান্ডারের পিতা রাজা ফিলিপ এই কৌশল প্রয়োগ করে পুরো গ্রিসকে এক করেছিলেন।
তবে এই বূহ্যের সামনের দিকটা শক্তিশালী হলেও পার্শ্ববর্তী আক্রমণ ঠেকানোর জন্য তেমন আদর্শ ছিল না। ফিলিপ সেজন্য ফালানক্সের দুপাশে ব্যবহার করতেন তারা অশ্বারোহী বাহিনী। আলেক্সান্ডারও তাই। শক্তিশালী ক্যাভালরি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তেন শত্রুপক্ষের দুর্বল স্থানে। নিজেই নেতৃত্ব দিতেন প্রিয় বুকোফ্যালাসের পিঠে চড়ে। শত্রুপক্ষের জন্য যমদূতের সমতুল্য ছিল এই যুদ্ধকৌশল।
আবারও পরাজয়ের উপক্রম দেখা দেয় পারস্য বাহিনীতে। আলেক্সান্ডারের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয় তারা। রাজা তৃতীয় দরিয়ুস পালিয়ে যান সেনাপতি বেসাসকে সঙ্গে নিয়ে। ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেক্সান্ডার বেরিয়ে পড়েন দরিয়ুসের খোঁজে। পারস্য বিজয় সম্পন্ন করার চূড়ান্ত ধাপ।
ওদিকে কাস্পিয়ান সাগরের কাছাকাছি গিয়ে বেসাস বিশ্বাসঘাতকতার নজির স্থাপন করে। দরিয়ুসের বুকে ছুরি বসিয়ে নিজেই নিজেকে ‘কিং অব দ্য কিংস’ ঘোষণা করে। চলে যায় ব্যাকট্রিয়া প্রদেশের দিকে। পারস্য সাম্রাজ্যের একেবারে পূর্বপ্রান্তে। বর্তমান পৃথিবীর আফগানিস্তান, পাকিস্তান কিছু অংশ এবং তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তানের দক্ষিণ অংশ নিয়ে বিশাল প্রদেশ। বেসাস শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। মেসিডোনিয়ান ঝড় যে এদিকেও ধেয়ে আসবে, সেটা অনুমেয়।
আলেক্সান্ডারের লক্ষ্য একদম পরিষ্কার। তিনি এশিয়ার মালিক হতে চান। সে জন্য আগে বেসাসকে বধ করতে হবে। ব্যাকট্রিয়ার সীমানাজুড়ে অসংখ্য সৈন্য মোতায়েন করা ছিল। আলেক্সান্ডার মাস্টার স্ট্রোক খেলার চেষ্টা করলেন। তিনি প্রবেশ করবেন হিন্দুকুশ পর্বতমালা দিয়ে। ইউরোপীয়রা একে ইন্ডিয়ান ককেশাসও বলে।
পাঠক, আলেক্সান্ডার কিভাবে হাজার-হাজার সৈন্য আর ঘোড়ার দল নিয়ে হিন্দুকুশ অতিক্রম করলেন, সেই ব্যাখা আমার কাছেও নেই। আসুন, একসাথে অবাক হই।
মজা করলাম। যতদূর জানা যায়, তিনি স্থানীয় রাজ্যগুলো থেকে পাহাড়িদের সহায়তা পেয়েছিলেন। তাছাড়া তার ফৌজ ছিল দুর্গম অঞ্চলে বিচরণের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত।
হানিবাল যেমন রোমকে পদানত করতে আল্পস পর্বতমালা পাড়ি দিয়েছিলেন, ঠিক সেরকম একটা প্রচেষ্টা ছিল।
ব্যাকট্রিয়ায় প্রবেশের পর ভেঙে ফেলা হলো বেসাসের সবরকম প্রতিরোধ। আলেক্সান্ডার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে ভারতবর্ষের ওপর।
প্রাচীন গ্রীসের হোমারিক বিশ্বাস অনুযায়ী, ভারতই হলো পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসও একই মত দিয়েছিলেন। ভারতই পৃথিবীর পূর্বতম প্রান্ত। সেখান থেকে নাকি দেখা মেলে ওশানাসের। কল্পিত এক সমুদ্র, যা পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে।
প্রথম প্রতিরোধ
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ এ ভারতের উত্তর প্রান্ত দিয়ে আলেক্সান্ডার অগ্রসর হওয়া শুরু করলেন। উত্তর ভারত তখন ছিল ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে বিবাদেই তারা ব্যস্ত। ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে তারা কাজ করতে পারে নি। তাই আলেক্সান্ডারের কাজটা সহজ হয়ে যায়। বিশাল মেসিডোনিয়ান বাহিনীকে ধেয়ে আসতে দেখে সবাই একে একে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়। বাঁধ সাধলেন রাজা পুরু। ঝিলাম আর চিনাব নদের মাঝে পুরুর রাজ্য।
গ্রিকরা যখন ঝিলামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ স্কাউটদের কাছ থেকে খবর এলো। উপকূলে জড়ো হয়েছে বিশাল এক ভারতীয় বাহিনী।
আলেক্সান্ডার পুরুকে চিঠি মারফত বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বললেন। জবাব এলো,"হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে যাব। কিন্তু সসৈন্যে। আমাদের দেখা হবে রণক্ষেত্রে।"
যুদ্ধ আসন্ন।
গেম অব থ্রোন্স এ দেখানো ‘ব্যাটল অব বাস্টার্ডস’-এর সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির কথা মনে করতে পারেন। তলোয়ার হাতে একা জন স্নো দাঁড়িয়ে আছেন। উলটো দিক থেকে ধেয়ে আসছে রামসে সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সেনা। জনকে বাঁচাতে আবির্ভাব ঘটে স্টার্ক অ্যালায়েন্সের। পুনরুদ্ধার করা হয় উইন্টারফেল।
জন স্নো একটা কল্পিত চরিত্র। কিন্তু ইতিহাস এমনই এক বীরের দেখা পেয়েছে ঐতিহাসিক ঝিলামের যুদ্ধে। অকুতোভয় পুরু যে সাহস দেখিয়েছেন, সেটার কোনো ব্যাখা আপনি করতে পারবেন না। শক্তিশালী গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন তিনি প্রতিরোধের ছক কষছেন, ময়দানে সেনারা নিয়ে আসেন তাদের হস্তী বাহিনী।
ঐতিহাসিক ঝিলামের যুদ্ধ
গ্রিক বাহিনী এবার মুখোমুখি হলো নতুন ধরনের এক পরীক্ষার। একদিকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হচ্ছে অশ্বারোহী দল, একইসাথে ওপর থেকে তীরন্দাজরা নিক্ষেপ করে চলছে একের পর এক ধনুক। বেশ কঠিন পরীক্ষাই দিতে হলো আলেক্সান্ডারকে। কিন্তু শেষ অব্দি বিজয়ীর বেশে যুদ্ধের ইতি টানলেন। তবে
পুরুর বীরত্বের অমর্যাদাও তিনি করেননি। ফিরিয়ে দেন তাঁর রাজ্য।
আর একটু পথ
ঝিলামের প্রান্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভ করলেও ভারতের মূল ভূখণ্ড তখনো গ্রিকদের কাছে অধরা। আলেক্সান্ডার বিশ্বজয়ের নেশায় পুরোপুরি মত্ত। সৈন্যদল নিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে এগিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ওদিকে মহাপরাক্রমশালী মগধ রাজ্য। বর্তমান বিহার এবং বাংলার কিছু অংশ নিয়ে পাটলিপুত্রের রাজা ধনানন্দের বিশাল রাজত্ব। মগধ সেনাবাহিনীতে শুধুমাত্র হস্তীসংখ্যাই ২০ হাজারের মত। খবর শুনে মেসিডোনিয়ান সৈনিকরা আর এগোনোর সাহস পেল না। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত গ্রিক সৈন্যরা পুরুর হস্তী বাহিনীর ধাক্কাই তখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি। ঝিলামের যুদ্ধ গ্রীকদেরকে অনেকটা দুর্বল করে দিয়েছিল। দীর্ঘসময় আগে মাতৃভূমি ছেড়ে আসা সৈনিকরা চাচ্ছিল, এবার কাছের মানুষদের কাছে ফিরে যেতে।
তবে আলেক্সান্ডার এত কাছাকাছি এসে ফিরে যেতে চাননি। এইতো, আরেকটু পথ। দিচ্ছে বিশ্বজয়ের হাতছানি। অনেক চেষ্টা করলেন সেনাবাহিনীকে আশ্বস্ত করতে। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সেনারা। দুর্গম অঞ্চল পেরিয়ে মগধের পতন ঘটানো তখন অলীক কল্পনামাত্র।
মেসিডোনিয়ানদের জয়যাত্রা সেখানেই থেমে গেল। একরকম পলায়নই করতে হলো তাদেরকে। ফেরার সময় ধরলেন বেলুচিস্তানের ভয়ঙ্কর মরুর পথ। নরকের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনমতে ফিরতে পেরেছিলেন সুসায়। কিছুদিনের মধ্যে খবর এলো। ভারতের যেটুকু অঞ্চল গ্রিকদের অধীনস্থ ছিল, তাও আর নেই। মৌর্যবংশের প্রথম সম্রাট গুপ্তচন্দ্র বিতাড়িত করেছেন গ্রীক শক্তিকে।
মেসিডোনিয়ানরা রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল ভারতে। তবে এই বহিরাক্রমণ এক দিক দিয়ে উপকারও করেছে আমাদের। প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ বিদ্যার রীতি ছিল না। যেটুকু যা আজকে জানতে পারি, তার সূচনা হয়েছিল গ্রিক ঐতিহাসিকদের হাত ধরে। ভারতীয় সভ্যতা কেমন ছিল, গ্রিকরাই সর্বপ্রথম সেগুলো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে।
দিনশেষে আমরা দেখতে পাই, আলেক্সান্ডারের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিল ভারতের ভূখণ্ড। ধৈর্যশক্তির চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে ছাড়ে এই অঞ্চল। একে জয় করতে হলে বিশেষ কিছু করে দেখাতে হতো তাকে।
জীবনানন্দ বলে গেছেন,
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে।
...আমি ক্লান্ত প্রাণ এক...’