ক্রিকেট বিশ্বকাপ : আরও সক্রিয় হচ্ছে অনলাইন জুয়ার সাইট
আগামী এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্রিকেটের জোয়ারে ভাসবে সারা বিশ্ব।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: পাশের দেশ ভারতে শুরু হতে যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ক্রিকেটপ্রেমীদের উন্মাদনা শুরু হয়েছে দেশব্যাপী। আগামী এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্রিকেটের জোয়ারে ভাসবে সারা বিশ্ব। বিশ্বকাপকে নিয়ে ভক্তদের পাশাপাশি অনলাইন জুয়াড়িরাও সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। সারা বছরই অনলাইন জুয়ার রমরমা ব্যবসা চলে দেশে। তবে, বিশেষ কোনো ইভেন্টে সক্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। যেহেতু অনলাইন বেটিং (জুয়া) সাইটগুলো অধিকাংশ খেলাধুলা কেন্দ্রিক, তাই ক্রিকেট বিশ্বকাপ বড় একটি ইভেন্ট জুয়াড়িদের জন্য।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো ক্রিকেট বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে বিদেশি অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নেট জগতে বেড়েছে। এসব বিজ্ঞাপন দেখে এবং ক্রিকেট বিশ্বকাপকে সামনে রেখে অনেক নতুন নতুন গ্রাহক অনলাইন জুয়ার সাইটে লগইন করছেন। আরও জানা গেছে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ সামনে রেখে অনলাইন জুয়ার সাইটে এক শ্রেণির শিক্ষিত যুবকও যেমন লগইন করছেন, তেমনি নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবীরাও অনলাইন জুয়ায় আকৃষ্ট হচ্ছেন।
অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো ক্রিকেট বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে বিদেশি অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নেট জগতে বেড়েছে। এসব বিজ্ঞাপন দেখে এবং ক্রিকেট বিশ্বকাপকে সামনে রেখে অনেক নতুন নতুন গ্রাহক অনলাইন জুয়ার সাইটে লগইন করছেন
বিজ্ঞাপন
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রায় ১৫০টির ওপরে অনলাইন জুয়া কিংবা বেটিং সাইট সক্রিয় রয়েছে। তবে, ক্রিকেট বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে এ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। এসব সাইটে প্রায় ২০ লাখের মতো মানুষ বেটিং কিংবা জুয়া খেলে থাকেন। এসব জুয়ার সাইট অধিকাংশ রাশিয়া কেন্দ্রিক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘুরে দেখা যায়, সারা বছরই এসব জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে। তবে, ক্রিকেট বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এসব অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন কয়েক গুণ বেড়েছে। নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব অনলাইন সাইট নেটিজেনদের জুয়া খেলার জন্য আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। তাদের বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, ‘৬০০ টাকায় লাখ টাকা জিতে নিন’, ‘মিনিটেই টাকা আপনার বিকাশ, নগদ কিংবা রকেট অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। বিজ্ঞাপনে আরও বলা হচ্ছে, ‘এসব জুয়ার সাইট বাংলাদেশে বৈধ।’ এ ছাড়া, বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন তারকা ক্রিকেটারের ছবি।
এসব সাইটের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকটি সাইটে বিনামূল্যে রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে। কিছু কিছু সাইটে ৩০০-৫০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হচ্ছে। এসব জুয়ার সাইটের বাজির টাকা মূলত লেনদেন হচ্ছে নগদ, বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে। পরে এসব সাইটের স্থানীয় এজেন্টরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা বিদেশে পাচার করছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, এসব অনলাইন জুয়ার সাইট মূলত পরিচালিত হচ্ছে রাশিয়া, চীন ও সাইবেরিয়া থেকে। এ তিন দেশের জুয়ার মালিকরা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে তাদের স্থানীয় এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে। অনলাইনে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। তাদের (এজেন্ট) মাধ্যমে এ তিন দেশে জুয়ার সাইট পরিচালিত হচ্ছে। এজেন্টরা লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট একটি কমিশন পেয়ে থাকেন। বাকি টাকা হুন্ডিসহ নানা মাধ্যমে বিদেশে পাচার করছেন। কোনো এজেন্ট যদি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন, তাহলে তারা দ্রুত সাইটের নাম পরিবর্তনসহ নতুন এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা যায়, প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিটিআরসিকে অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন সাইটের নাম, লিংক ও স্ক্রিনশটসহ তালিকা দিচ্ছে। তালিকা দেওয়ার পর বিটিআরসি সেসব অনলাইন জুয়ার সাইট দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপন দেওয়া বেশ কয়েকটি অনলাইন জুয়ার সাইটের তালিকা বিটিআরসির কাছে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই মোতাবেক সাইটগুলো বন্ধের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। এভাবে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে বিটিআরসি। তবে, সমস্যার বিষয়টি হচ্ছে সাইট বন্ধ করলেও অনলাইন জুয়া থেমে নেই। কারণ, এসব সাইট বন্ধ করার পর নতুন নামে এবং ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করে আবারও শুরু করছে চক্রের সদস্যরা। ১০০ সাইট বন্ধ করলে দেখা যায় ২০০ সাইট ওপেন হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব সাইট অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেয়। সেগুলো বন্ধ করার জন্য আমরা নিয়মিত বিটিআরসিকে তালিকা পাঠাই। লিংক দিয়ে কিংবা স্ক্রিনশট দিয়ে আমরা বিটিআরসিকে বলি, বাংলাদেশের চলমান আইন অনুযায়ী এসব সাইট অবৈধ। এগুলো জনস্বার্থে যেন দ্রুত বন্ধ করা হয়। অন্যদিকে, এসব জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী দেশীয় কয়েকজন এজেন্ট, যারা জুয়ার টাকা লেনদেন করেন, এমন বেশ কয়েকজন আমাদের মনিটরিংয়ে আছেন। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করব।
গত এক বছরে হুন্ডির মাধ্যমে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে— বলছে সিআইডি / ফাইল ছবি
‘গত এক বছরে আমরা দেশের ৮-১০ জেলায় অভিযান পরিচালনা করে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত প্রায় ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। এ ছাড়া, অনলাইন জুয়ার প্রায় ৫০ লাখ টাকা আমরা উদ্ধার করেছি।’
এদিকে, ক্রিকেট বিশ্বকাপকে সামনে রেখে অনলাইন জুয়ার সাইটের চক্রগুলোর বিরুদ্ধে তৎপরতা বাড়িয়েছে সিআইডি। সম্প্রতি ‘ওয়ান এক্স বেট’ নামের অনলাইন জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী চক্রের মূলহোতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) নেপালে পালিয়ে যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এ চক্রের মূলহোতা মো. মতিউর রহমানকে (২৯) গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
এ বিষয়ে সিআইডির মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, গত ৩১ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বনশ্রী, আগারগাঁও ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনলাইন প্লাটফর্ম মেল বেট (Mel Bet), ওয়ান এক্স বেট (1xBet), ও বেট উইনার (Bet winner) নামের বেটিং সাইটগুলো পরিচালনাকারী চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। ডিএমপির পল্টন মডেল থানায় একটি মামলাও রুজু হয়েছে। সেই চক্রের মূলহোতা মো. মতিউর রহমান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব সাইট অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেয়। সেগুলো বন্ধ করার জন্য আমরা নিয়মিত বিটিআরসিকে তালিকা পাঠাই। লিংক দিয়ে কিংবা স্ক্রিনশট দিয়ে আমরা বিটিআরসিকে বলি, বাংলাদেশের চলমান আইন অনুযায়ী এসব সাইট অবৈধ। এগুলো জনস্বার্থে যেন দ্রুত বন্ধ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মতিউর রহমান জানায়, তিনি ২০১৭ সালে পড়াশোনা করার জন্য রাশিয়ায় যান। সেখানে গ্রাজুয়েশন শেষ করে সোশ্যাল ওয়ার্কে মাস্টার্স করছেন। ২০২১ সালে ওয়ান এক্স বেট ও বেট উইনারের সঙ্গে যুক্ত হন। পাঁচ হাজার ডলার সিকিউরিটি মানি দিয়ে ওয়ান এক্স বেট এবং তিন হাজার ডলার দিয়ে বেট উইনারের এজেন্টশিপ নেন।
বাংলাদেশে জুয়ার সাইট পরিচালনার জন্য আগে গ্রেপ্তার ছয়জনের সহায়তায় একটি চক্র গড়ে তোলেন মতিউর। চক্রের সদস্যদের মধ্যে সৈকত রানা, সাদিকুলসহ আরও কয়েকজন তাদের এমএফএস এজেন্ট নম্বর ব্যবহার করে টাকা লেনদেন করতেন। পরবর্তীতে সব এজেন্টের কাছ থেকে সংগ্রহ করা টাকা সৈকত ও মতিউর যৌথভাবে পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে তারা প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা হুন্ডি করে দেশের বাইরে পাচার করেন।