শুধু জেলেরাই পাতেন না নিষিদ্ধ জাল, আছে পুলিশ প্রশাসনও

শুধু জেলেরাই পাতেন না নিষিদ্ধ জাল, আছে পুলিশ প্রশাসনও

প্রথম নিউজ, অনলাইন :  দশমিনা উপজেলার সইজ্জাপুর গ্রামের জেলে হেমায়েত মাছ শিকার করেন বাঁধাজাল দিয়ে। এটি বেহুন্দি জাল নামেও পরিচিত। তার জালে তিন-চার দিন বয়সের মাছের পোনাসহ আটকা পড়ে মাছের ডিমও। মাঘ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত তার ওই জালে যে মাছ ধরা পড়ে, তার ৮০ শতাংশই ইলিশের বাচ্চা।
প্রতি টানে দুই থেকে আড়াই মণ ইলিশের পোনা উঠে আসে তার জালে। ইলিশের ওই পোনাগুলো ‘চাপলি’ নামে পরিচিত।

এভাবে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে দিনের পর দিন জেলেরা অবাধে মাছ শিকার করে যাচ্ছেন কিভাবে? হেমায়েতদের মতো শুধুই মাছ ধরে জীবন চালানো জেলেদের মুখ থেকে শোনা যায় ভয়ংকর জবাব। নিষিদ্ধ জাল শুধু জেলেরাই পাতেন না, পুলিশ প্রশাসনও অবৈধ আয়ের জাল বিছিয়ে রেখেছে নদী-সাগরে।
মূলত পুলিশকে ঘুষ দিয়েই নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার চলছে অবাধে।  অনুসন্ধানে তার সত্যতাও মিলেছে।

ইলিশ শিকারের জন্য সর্বনিম্ন ৬.৫ সেন্টিমিটার ফাঁসের সুতার জাল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও জেলেরা অহরহ ব্যবহার করেন ৩ থেকে ৩.৫ সেন্টিমিটার ফাঁসের কারেন্ট জাল। মশারির মতো ফাঁসের আরেকটি জাল ব্যবহার করে মাছের সব ধরনের পোনা ধ্বংস করা হয়।
এটির নাম পাইজাল। আবার চাপিলা শিকারে ব্যবহার করা হয় ১.৫ থেকে ২ সেন্টিমিটার ফাঁসের কারেন্ট জাল, যা জেলেদের ভাষায় ২৫ বা ৩০ কারেন্ট জাল; আবার কারো কাছে চাপলি জাল নামেও পরিচিত।

লালমোহন উপজেলার গাইমারা এলাকার জেলে আলমগীর হোসেন জানান, এই জাল নদীতে ফেলার এক ঘণ্টার মধ্যে পুরো জালের ফাঁস ভরে যায় চাপলিতে। এক খ্যাপে পাঁচ থেকে সাত মণ চাপলি ওঠে। এক জালের চাপলি খুলতে ১৫-২০ জন মানুষের তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
 

তিনি আরো জানান, কারেন্ট জাল ২৫ নম্বর থেকে শুরু করে ১০০ নম্বর পর্যন্ত আছে। সবই নিষিদ্ধ, অথচ অবাধে ব্যবহার করে চলেছেন নদী ও সাগরের জেলেরা।

এ ছাড়া রয়েছে ডুবোচরগুলোতে ব্যবহারের জন্য ব্যাড় বা মশারি জাল। ভাটার সময় এই জাল চরের মাটিতে পুঁতে রাখা হয় এবং জোয়ারে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। ভাটায় পানি নেমে গেলে জালের বেড়ে আটকা পড়ে ডুবোচরের ছোট-বড় সব মাছ। মাছের ডিমও বের হতে পারে না এই জাল থেকে।

জাল পাততে টাকা লাগে : উপকূল এলাকার বিভিন্ন নৌফাঁড়ি ও থানার পুলিশরা জেলেদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে নিষিদ্ধ জাল পাতার সুযোগ দেয়। জালের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের ‘ফি’ পরিশোধ করতে হয় পুলিশকে।

পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বাঁশবাড়িয়ার জেলে আফজাল খাঁ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাজীরহাট ফাঁড়ির পুলিশকে মাসে এক হাজার টাহা দেই আমি। ওই ফাঁড়ির পুলিশের খাতা আছে। ওই খাতায় আমার নাম আছে। সব জাইল্যার নাম হেগো খাতায় আছে। জালের ধরন অনুযায়ী সব জাইল্যারে মাসে টাহা দেতে অয়। টাহা না দেলে জাল ধইরগ্যা লইয়া যায়। ওই ফাঁড়িতে পুলিশের একজন দালাল আছে কবির নামে। সে ট্রলার লইয়া নদীতে আইয়া টাহা উডায় জাইল্যাগো তন। কেউ আবার সরাসরি ফাঁড়িতে যাইয়া টাহা দেয়। কোনো অভিযান অইলে আমাগোরে আগে ফোন দেয়; আমরা সাবধান অইয়া যাই। আবার হঠাৎ অভিযানে নামলে নাম জিগায়; খাতায় নাম থাকলে কোনো সমস্যা অয় না।’

কেন টাকা দেন? প্রশ্নের জবাবে আফজাল খাঁ বলেন, ‘ছয়জনের সংসারের খরচ। কিস্তিও আছে এনজিওর। জাল-নৌকার আয় ছাড়া আর কিছু নাই। দুই-চাইরডা ইলিশ পাওয়ার লাইগ্যা কারেন্ট জাল বাই। জালডা লইয়া গেলে খামু কী? এই লাইগ্যা পুলিশরে টাহা দেই।’

ওই এলাকার জেলে আবুল হোসেনও বলেন একই কথা। তিনিও তেঁতুলিয়া নদীতে কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন। তাকেও মাসে এক হাজার টাকা দিতে হয় ওই ফাঁড়ির পুলিশকে। আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি একা না, সব জাইল্যাই এক হাজার করে পুলিশরে দেয়।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাজীরহাট নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ফেরদৌস আহম্মেদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমি এক মাস আগে এখানে আসার পর থেকে কোনো জেলের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে না। আশা করি, হবেও না।’

এই ফাঁড়ির ট্রলারচালক কবিরকে প্রশ্ন করলে বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা কথা।’ এক জেলে আপনার টাকা নেওয়ার ভিডিও ফুটেজ দেখাইছে—বলা হলে জবাবে কবির বলেন, ‘আমার বাবা মাছের ব্যবসা করে। আমি মাছ কিনি। টাকা-পয়সার লেনদেনের ভিডিও দেখাইতেই পারে। তবে নৌফাঁড়ির ট্রলারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আমি কোনো জেলের কাছ থেকে টাকা নেই নাই। আর ওই চাকরি এখন আমার নাই।’

গত ১৬ নভেম্বর সকালে এসব কথা হওয়ার পর রাতেই আবার কবিরের ফোন। বলেন, ‘ভাই, আপনার বিকাশ নাম্বারডা দেন।’

কেন? প্রশ্ন করলে কবির বলন, ‘তহন ধারেকাছে লোকজন ছেল, তাই বলতে পারি নাই। আমনে নাম্বারডা দেন।’ তার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে একটা ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিই।

ভোলার লালমোহন উপজেলার চরপাতা গ্রামের জেলে নিজাম ব্যাপারী বলেন, ‘আমার ঘর-সংসার, কিস্তি এই জালের কামাইয়ের উপর। আমি এক হাজার টেয়া (টাকা) দিয়া সব ঠিক রাহি। কারেন্ট জালে ছোড মাছের ক্ষতি অয় জানি; কিন্তু কী করমু? খামু কী?’

ইলিশ শিকারে কারেন্ট জাল ব্যবহার করতে বাউফলের কালাইয়া নৌফাঁড়ির পুলিশকে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন বদরপুর গ্রামের কবির মোল্লা, নাজিরপুর গ্রামের ফারুক মাঝি, বদরপুর গ্রামের জান্টু মাঝি, চর কচুয়ার নীরব মাঝি, বাউফলের নিমদি গ্রামের আকবর ব্যাপারী, সোহেল হাওলাদার, রাসেল হাওলাদার ও রাসেল রাড়ি।

জানতে চাইলে কালাইয়া নৌফাঁড়ির ইনচার্জ গাজী সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমি নৌ পুলিশে এই প্রথম; এখানে আসছিও নতুন, অক্টোবরের শুরুতে। আমিও শুনেছি এমন অভিযোগ। তবে আমি চেষ্টা করছি নিষিদ্ধ জাল বন্ধের। অনেক জেলের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বুঝিয়েছি, এভাবে আপনারা ইলিশ শিকার করলে আমাদের ইলিশ হারিয়ে যাবে; তখন আপনারা না খেয়ে থাকবেন।’

ওদিকে বাঁধাজালের মাছ শিকারে ফি দিতে হয় বেশি। দশমিনার সইজ্জাপুর এলাকার মো. আকরাম জেলে বলেন, ‘আমার বাঁধাজাল ৮ গ্রাফির। হাজীরহাট ফাঁড়ির পুলিশকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। না দিলে জাল বাইতে দেয় না।’ লালমোহনের জেলে মকবুল বলেন, ‘ছোট বাঁধাজালে ৪ কিংবা ৬ গ্রাফির জালে দুই থেকে তিন হাজার টাকা মাসে পুলিশকে দিতে হয়। আমাগো আত-পাও (হাত-পা) বাঁধা পুলিশের ধারে।’

লালমোহন উপজেলার গাইমারা গ্রামের মো. আলী, মো. আলমগীর, মো. ইসলাম, মো. জামাল, শামসুদ্দিন—সবাই বাঁধাজাল দিয়ে চাপলি শিকার করেন। তাদের বাঁধাজাল ছোট হওয়ায় মাসে ওই ফাঁড়ির পুলিশকে দিতে হয় দুই হাজার টাকা করে।

তবে সব জেলের কাছ থেকে পুলিশ সরাসরি টাকা নেয় না। যেসব জেলে আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন নেওয়া, তাদের মাছ বিক্রির পর কমিশনের সঙ্গে পুলিশের টাকাও আড়তদাররাই কেটে রাখেন; পরে পুলিশকে পরিশোধ করেন। বাউফলের বগি এলাকার দাদন নেওয়া জেলে মোতাহার, মিলন, শাকির ও মাইনুদ্দিন এসব কথা বলেন। তারা এলাকার আড়তদার জুয়েল মৃধাকে মাছ দিয়ে থাকেন।

জানতে চাইলে জুয়েল মৃধা বলেন, ‘আমি ১২ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করি। আমাকে অনেক সময় অনেক কিছুই ফেস করতে হয়। সরকার অনেক জাল, অনেক ব্যবসা অবৈধ ঘোষণা করছে। অনেক মাছ ধরা অবৈধ, নিষিদ্ধ। তার পরও জেলেরা চুরি করে ধরে; আমরা চুরি করে কিনি, চুরি করেই বাজারজাত করি। এটাই আমাদের বাস্তবতা।’

কলাপাড়ায় সিন্ডিকেট : এ উপজেলার জেলেরা বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল। ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। প্রথম সপ্তাহে সব ধরনের মাছ শিকারে বিরত থাকেন জেলেরা। এরপর সক্রিয় হয় সিন্ডিকেট। ওই নিষেধাজ্ঞার সময় কুয়াকাটার মেয়র বাজারের আড়তদার ও জেলেদের সিন্ডিকেট ম্যানেজ করেন নূর জামাল গাজী নামের এক ব্যক্তি। পুলিশ, সাংবাদিক আর কোস্ট গার্ডকে ম্যানেজ করার জন্য প্রত্যেক জেলের কাছ থেকে আদায় করা হয় মাসে পাঁচ হাজার টাকা। এই টাকা জেলেরা ক্যাশ দেন না; মাছ শিকার করে আড়তে ফিরে আসার পর বিক্রীত অর্থ থেকে এক মাসের জন্য পাঁচ হাজার টাকা কেটে রাখা হয়। এ কারণে তখন কুয়াকাটার মাছ বাজারগুলো থাকে সরগরম।

অভিযোগের বিষয়ে নূর জামাল গাজী বলেন, ‘সবাইরে ম্যানেজ করি না। চুরি কইরগ্যা মাছ ধরি। সবার সাথে আমাগো একটা সমন্বয় থাকে।’

করণীয় কী : এই প্রশ্নে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের প্রফেসর ড. মো. লোকমান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইলিশ রক্ষায় সর্বপ্রথম অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। জাতীয়ভাবে দীর্ঘমেয়াদি একটা পরিকল্পনা নিতে হবে; তাতে সব জেলেকে তালিকাভুক্ত করে প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি মোটিভেশন করাতে হবে। জেলেদের দেওয়া সরকারি প্রণোদনা অপর্যাপ্ত। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এটি সঠিক মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে।’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘মাইগ্রেশন বা স্থানান্তর স্বভাবের মাছ হলো ইলিশ। ইলিশের মায়ের বাড়ি হলো নদী; সেখানে ডিম ছেড়ে বাচ্চা ফুটিয়ে ফিরে যায় সাগরে। বাচ্চারাও বড় হলে সাগরে চলে যায়। আবার বড় হয়ে ডিম ছাড়তে ফিরে আসে মায়ের বাড়ি নদীতে। এই মায়ের বাড়িতেই ইলিশের যত বিপত্তি। নদীতে অবৈধ জালের ছড়াছড়ি। ফলে একমুহূর্ত ইলিশ নদীতে এসে শান্তিতে থাকতে পারে না। যখন সাগর থেকে নদীতে বা নদী থেকে সাগরে ফিরতে যায়, তখন মোহনায় চরগড়া, বেহুন্দি আর কারেন্ট জালে শেষ হয়ে যায় ইলিশ। আবার জেগে ওঠা অসংখ্য ডুবোচরও বড় বাধা। নদীতে দূষণ বাড়ছে; সেই পানিতে ঠিকমতো ডিম ফুটতে না পারার কারণেও ইলিশ কমছে দ্রুত। একটা ইলিশ তিন লাখ থেকে ৩০ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। এরা যদি ঠিকমতো ডিম ছাড়তে পারত, তাহলে ইলিশের আকাল দেখা যেত না।’

এই গবেষক আরো বলেন, ‘জেলেদের আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে সবার আগে। ঋণগ্রস্ত জেলেদের ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা থাকতে হবে। সিভিল প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ প্রশাসন, কোস্ট গার্ড—এদের আন্তরিক হতে হবে শতভাগ। জিরো টলার‌্যান্স নীতিতে আসতে হবে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের।

এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের কেউ কোনো ধরনের দুর্নীতি করলে তাকে ওএসডি না করে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে হবে। কোনো জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক নেতা এ ক্ষেত্রে সামান্যতম দোষী প্রমাণিত হলে তাকে জামিন অযোগ্য সাজা দিতে হবে। এরপর অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই রক্ষা পাবে দেশের সম্পদ ইলিশ।’