নিপীড়নেও ঐক্যবদ্ধ বিএনপি
প্রথম নিউজ, ঢাকা: টানা ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা জেল জুলুম নির্যাতনসহ হাজারো নিপীড়ন ও চাপের মধ্যেও ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানো বিএনপি প্রথম চাপে পড়ে ১/১১ এর সময়। সে সময় বিএনপি চেয়ারপাারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ও বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। সে সময় ভয়াবহ নিপীড়ন নেমে আসে তাদের উপর। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ নেতাকর্মীরা মুক্তি পেলেও সে থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপির উপর নিপীড়ন থেমে নেই। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২২ শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ২০০৯ সালে তারা ক্ষমতায় বসে। এরপর ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারীর একতরফা নির্বাচনে টানা চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।
টানা এ ১৭ বছরের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। গুম ও খুনের শিকার হয়েছেন বহুসংখ্যক নেতাকর্মী। মিথ্যা গায়েবি মামলায় তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জর্জরিত। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরি, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধরি, শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সারোয়ার, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, লায়ন আসলাম চৌধুরি, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সহ সাংগঠনিক সম্পাদ শরীফুল আলম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিশ হাজারের বেশি নেতাকর্মী এখনও কারান্তরীন রয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান মেজন (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ শাহজাহান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, হাবিব-উন নবী সোহেল, হাবিবুল ইসলাম, মীর শরাফত আলী সপু, সাইফুল ইসলাম নিরব, সুলতান সালা উদ্দিন টুকু, শামীমুর রহমান শামীমসহ ১৭শ এর অধিক নেতাকর্মীকে গত কয়েক মাসে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীসহ সিনিয়র এমন কোন নেতা নেই যাদের বিরুদ্ধে ২শ থেকে তিনশ মামলা নেই। এত নিপীড়নের মধ্যেও বিএনপি নেতাকর্মীরা দল ছেড়ে যায়নি।
রাজনীতিক বিশ্লেষকদের মতে বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বয়কট করলেও এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলটির ঐক্য ও মনোবল আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ,সরকারের ক্রমাগত চাপে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে অল্প কিছু নেতা ভোটে গেলেও বাকিরা বিশেষ করে সিনিয়র নেতারা হাইকমান্ডের প্রতি ছিলেন পুরো অনুগত। এটাকে এক ধরনের সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অথচ নির্বাচনের আগে দল ও রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন ছিল, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও দলটির সিনিয়র অনেক নেতা স্বতন্ত্র কিংবা অন্য দল থেকে নির্বাচন করবেন। এতে করে ভোটকে ঘিরে দলে ভাঙন স্পষ্ট হতে পারে। নির্বাচনের আগে মহাসচিবসহ সিনিয়র ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা গ্রেপ্তার হলেও দলের সঙ্গে বেইমানি করেননি, ভোটেও যাননি। এর মধ্য দিয়ে দলে তারেক রহমানের নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির মাঠের বাইরে রয়েছেন। এ কারণে দল পরিচালনায় কোনো বিষয়ে সাধারণত তিনি সিদ্ধান্ত দেন না। সংগত কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার এমন অনুপস্থিতিতে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়া তারেক রহমান আদালত থেকে জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালে সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া একটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে গেলে ওইদিন রাতেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তারেক রহমানকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। বর্তমানে লন্ডনে থেকে দল পরিচালনা করছেন তিনি। একপর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই দলীয় সরকারের অধীনে ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি; কিন্তু নির্বাচনে ভরাডুবির পর ঘুরে দাঁড়াতে সংগঠন গোছানোয় মনোযোগ দেয় দলটি। পরবর্তী নির্বাচন ও আন্দোলন সামনে রেখে তখন থেকেই অত্যন্ত আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত নেতাদের দায়িত্বে আনেন তারেক রহমান।
সংগঠন গুছিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে দলটি। এরপর গত ১২ জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। নির্বাচন বয়কট করে দাবি আদায়ে ২৯ অক্টোবর থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর আন্দোলন শুরু করে দলটি। বিএনপিসহ যুগপতের মিত্রদের আন্দোলনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন ছিল, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলেও দলটির অনেক নেতা স্বতন্ত্র কিংবা অন্য দল থেকে নির্বাচন করবেন। বিশেষ করে নির্বাচন ঘিরে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে বিএনপির এক থেকে দেড়শ নেতা ভোট করবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সফল হননি। বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি থেকে ১১ জন সাবেক এমপি ভোট করেন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিএনপির। তবে তারা কেউ ডাকসাইটের নেতা নন। উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা প্রতীকে এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এ কে একরামুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করেন। নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নির্বাচনের আগে জামিনে কারামুক্ত হয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দেন শাহজাহান ওমর।
এ ছাড়া বিএনপির আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামান, বহিষ্কার হওয়া ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ, সাবেক এমপি ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা মোহাম্মদ শোকরানা নির্বাচন করেন। এদিকে নির্বাচনের আগে তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করে ভোট করেন বিএনপির বহিস্কৃত সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বহিষ্কার হওয়া তৈমূর আলম খন্দকার। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে বিএনএমে যোগদান করে ভোট করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ও দলের সাবেক এমপি শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। তবে তাদের মধ্যে কেবল শাহজাহান ওমর ও একরামুজ্জামান বিজয়ী হন। ভোটের আগে দল ও রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন ছিল, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ দল ছেড়ে বিএনএমের চেয়ারম্যান হয়ে ভোট করবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বিএনপির সঙ্গেই থেকেছেন।
এদিকে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে যাওয়ায় নেতাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার ন্যূনতম কোনো আগ্রহও নেই। যদিও নির্বাচন ঘিরে বহিষ্কৃতরা দলে ফিরতে চান, এমন কোনো কথা তারা এখনো বলেননি। তবে ভবিষ্যতে ভুল স্বীকার করে দলে ফিরতে আবেদন করলেও তাদের জন্য বিএনপির দরজা সহসাই খুলবে না। দলটির নেতারা বলছেন, তারা জেনে-শুনে-বুঝে বিএনপির সঙ্গে বেইমানি করেছেন। বেইমানির ফলও তারা পেয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, অনেকে মনে করেছিল, সিনিয়র নেতারা তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি তেমন আস্থাশীল না। এমন অবস্থায় এবার ভোটে না গেলে বিএনপি হয়তো ভেঙে যাবে; কিন্তু আন্দোলন সামনে রেখে তারেক রহমান এবার খুব সুন্দর স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন। দলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ান তিনি। ফলে একেবারে তৃণমূল থেকে দলটাকে একটা সফল রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। সে কারণে আমরা দেখেছি, আন্দোলনে সিনিয়র নেতাদের যত না সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা ছিল তৃণমূল থেকে উঠে আসা মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের। তবে এটা সত্য, নানা কারণে বিএনপির আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতা পায়নি। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, সরকারি নানা চাপ ও প্রলোভন সত্ত্বেও একমাত্র শাহজাহান ওমর ছাড়া পদধারী উল্লেখযোগ্য কেউ ভোটে যাননি। এখানেই বিএনপির সফলতা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন হাজারো নোকর্মীকে গুম করে, খুন করে, সাজা দিয়ে, লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে পারেনি সরকার। বরং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার অধীনে যেসব নির্বাচন হচ্ছে তাকে নির্বাচনই কেউ বলে না। সে কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ভোটে যায়নি। এ ধরণের নির্বাচন করে অতীতে প্রভুদের সহায়তায় পার পেলেও এবার আর পার পাবে না।