দলীয় বার্তার অপেক্ষায় জাপা’র নেতাকর্মীরা
রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। কিন্তু একেবারেই উল্টো পথে হাঁটছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি ও বিরোধী দলগুলো নানা চাপে। সরকারি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জোরেশোরে। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। কিন্তু একেবারেই উল্টো পথে হাঁটছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো ব্যস্ততা নেই দলটিতে। এখন চলছে তৃণমূলের কাউন্সিল কার্যক্রম। শীর্ষ নেতারা নির্বাচন নিয়ে দিচ্ছেন না স্পষ্ট কোনো বার্তা। নিয়মিত গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কড়া কথা বলছেন নেতারা। কিন্তু এসব কথায় খোদ ভরসা রাখতে পারছেন না দলের নেতাকর্মীরাই। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরের মতো তারা আর অন্য দলের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে চান না।
মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন সাধারণ কর্মী ও সমর্থকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হতাশা বিরাজ করছে তাদের মাঝে। রংপুরের মাঠ পর্যায়ের কর্মী সাজেদুল ইসলাম বলেন, আমরা এই মুহূর্তে ঘোষণা চাই ৩০০ আসনে নির্বাচনে যাচ্ছি নাকি কোনো দলের সঙ্গে যাচ্ছি। আর এই সুচিন্তিত ঘোষণার পর তা যেন পরিবর্তন না করা হয়।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বেশক’মাস ধরেই এককভাবে নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। তবে সম্প্রতি তার কথার সুর কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তিনি সম্প্রতি গাইবান্ধায় গণমাধ্যমকে বলেছেন, যদি দেখি নির্বাচন করার মতো অবস্থা আছে, তখন নির্বাচন করবো। না হলে পরবর্তীতে সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নেবো। আমরা যতদিন পর্যন্ত না ঘোষণা দিচ্ছি নির্বাচন বর্জন করছি, ততদিন পর্যন্ত আমাদের প্রচার চলতেই থাকবে।
দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের বৈঠকেও অবস্থা স্পষ্টকরণের চাপ ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা ও প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জাতীয় পার্টি দিনকে দিন গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। জিএম কাদের বরাবরই ভালো বক্তা। বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলেন। এই বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির টেবিলে টিকে থাকা যায়, মাঠে নয়। তিনি দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দাবি জানিয়ে বলেন, কোনো একটি দলকে সুবিধা দেয়ার জন্য ৩০০ আসনে নির্বাচনের কথা বললে দলের আর পায়ের নিচে মাটি থাকবে না।
খাতা-কলমে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছেন বিদেশি মেহমানরা। বরাবরের মতোই আলাপ শেষে দলটি বলছে, ৩০০ আসনে নির্বাচনের কথা আমরা জানিয়ে দিয়েছি। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভারত সফর নিয়েও আছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ভারত সফর থেকে ফেরার পর চেয়ারম্যান সেখানে আলোচনার বিষয়ে খোলাসা করেননি কিছুই। ঠিক তেমনি ভারত সফর শেষে কিছুটা নমনীয়ভাবেও কথা বলছেন। যদিও নিয়মিত সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছেন তিনি।
ভোটের মাঠেও দলটির অবস্থা যাচ্ছে তাই। গত ২৫শে মে হওয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে এমএম নিয়াজ উদ্দিন পেয়েছিলেন মাত্র ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট। আগস্টে হওয়া বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস পান মাত্র ৬ হাজার ৬৬৫ ভোট। একই দিনে হওয়া খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শফিকুল ইসলাম মধু লাঙ্গল প্রতীকে পান মাত্র ১৮ হাজার ৭৪ ভোট। গত ২১শে জুন অনুষ্ঠিত হওয়া সিলেট ও রাজশাহী সিটি নির্বাচনে যথাক্রমে লাঙ্গল ভোট পায় ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট ও ১০ হাজার ২৭২ ভোট। এই নির্বাচনগুলোতে বিএনপি অংশ নেয়নি। এরপরও কোনো সিটিতে নির্বাচিত হওয়া দূরের কথা সম্মানজনক ভোটও মেলেনি। তবে সিলেটে ভালো ভোট পেলেও এনিয়ে আছে প্রশ্ন। এছাড়াও এর আগে বিএনপি’র ছেড়ে দেয়া ছয়টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনেও একপ্রকার ভরাডুবিই হয় দলটির।
ক’দিন বাদেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সম্প্রতি গাইবান্ধায় হয়েছে দলটির জেলা দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন। এখানে ১১ বছর পর হয় এই সম্মেলন। এই এলাকায় আওয়ামী লীগের এমপি থাকলেও লাঙ্গলের জনপ্রিয়তা রয়েছে। গাইবান্ধা সদরের একজন বিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, এই আসনটিতে একটা সময় জাতীয় পাটির দুর্গ ছিল। আমরা যখন যুবক বয়সে ছিলাম তখন লাঙ্গল ছাড়া কোনো কথা ছিল না। কিন্তু এখন জাতীয় পার্টির গুরুত্ব একেবারেই কম। আবার নেতারাও আমাদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলাচল করেন। তিনি আরও বলেন, আমার ধারণা জাতীয় পার্টি দিনশেষে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে না। তাই আমরা চাই এখনি স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হোক। এই সময়ে আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার সময়। আর আমরা করছি কাউন্সিল।
গতকাল চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে যো০ দেন বহু নেতাকর্মী। অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তারাও এ নিয়ে শোনান হতাশার কথা। বলেন, আমরা নিয়মিত সাধ্যমতো অনুষ্ঠানে যোগ দেই। সুন্দর সুন্দর কথা শুনি। কিন্তু রাজনৈতিক যে গতি এটা মিলছে না। আমরা রাজনীতির মাঠে অন্যের ঘাড়ে চেপে চলতে চাই না। প্রায় একই সুরে কথা বলেন- অঙ্গসংগঠনের এক নেতা। তিনি বলেন, অনেক হয়েছে বক্তব্য। এবার মাঠের কর্মসূচি চাই আমরা।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, এই সিদ্ধান্তগুলোতো প্রেসিডিয়ামের মিটিংয়ে হয়। এটা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয় নাই। দলটির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সহিদুর রহমান টেপা বলেন, আমাদের প্রেসিডিয়াম মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে আমরা ৩০০ আসনে নির্বাচন করবো এবং আমাদের সেই সক্ষমতা আছে। আমরা সকলেই জিএম কাদেরের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেছি তিনি যেভাবে নির্বাচন করতে চান সেভাবেই আমরা করবো।
আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা ২৮ তারিখের পরই বোঝা যাবে। এই ২৮ তারিখের পর দেখা যাক কী হয় দেশের অবস্থা। এই দিনটা পর্যবেক্ষণ করে আমরা সিদ্ধান্ত জানাবো। এ বিষয়ে গতকাল মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, মানুষ আওয়ামী লীগ বিএনপি বোঝে না। দেশের মানুষ চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। আমরা নির্বাচনে যাবো কি যাবো না এটা কথা নয়। আমরা চাই সুষ্ঠু নির্বাচন।
দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, নির্বাচন সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। মানুষের কাছে অগ্রাধিকার হচ্ছে সামনের নির্বাচন। তিনি বলেন, আমরা সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সেইসঙ্গে আমরা ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।