ভ্যাট বাড়ায় চাপ বাড়বে ভোক্তার মানতে নারাজ অর্থ উপদেষ্টা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ভ্যাট বাড়ায় চাপ বাড়বে ভোক্তার মানতে নারাজ অর্থ উপদেষ্টা

প্রথম নিউজ, অনলাইন: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনতে যাচ্ছে সরকার। এতে বিস্কুট, আচার, কয়েল ও টিস্যু পেপারসহ প্রায় ৩ ডজনের অধিক পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ মূসক ও শুল্ক আরোপ হতে পারে। ফলে বাজেটের আগেই এসব পণ্য ও সেবার দাম একদফা বাড়তে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। এদিকে ভ্যাট বাড়ানোর খবরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রয়োজনে আন্দোলনে নামবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। সূত্র বলছে, মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। এসব সংশোধনীসহ মূসক ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়। ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে আগামী শনিবার অধ্যাদেশ আকারে জারি হতে পারে। 

এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদ ছাড়া কর বাড়ানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। এ কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশে অধ্যাদেশ দিয়ে কর বাড়াতে হচ্ছে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছর থেকেই প্রায় সব পণ্য ও সেবার ওপর একক ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর করতে চায় এনবিআর।

মূলত আইএমএফের শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সরকারের অর্থ দরকার। তাই বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ কিছুটা বাড়বে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে সাধারণ মানুষ যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেদিকেও নজর দিতে হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারকে দেয়া ঋণের শর্ত হিসেবে করছাড় কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর অংশ হিসেবে ভ্যাট হার যৌক্তিক করার কথা বলেছে। সংস্থাটির পরামর্শ মতে, মানুষের প্রতিদিন ব্যবহার্য ৬৫ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানো হতে পারে। গত বছরের শেষার্ধে সংস্থাটির সঙ্গে বৈঠক করে এনবিআর।
তালিকায় উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হলো: জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়োদুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ/সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল) ও বিমান টিকিট। এমনকি মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার এবং হোটেল-রেস্তরাঁয় খাবার খরচ বাড়বে। ভ্যাট বাড়লে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ঋণ দিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটির বেশি। এই অর্থ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার (৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা) সঙ্গে যোগ হবে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ব্যবসা বাণিজ্যে নানাবিধ সংকটে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি ভালো নয়। চলতি অর্থবছরের ৪ মাসে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় বাড়তি রাজস্ব আদায়ে ভ্যাট বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে একাধিক সূত্র জানায়।

রেস্তরাঁয় খেতে গেলে খাবারের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বসছে। আগে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়া হতো। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। পাশাপাশি পোশাক কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাটের হার বাড়তে পারে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মিষ্টি কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ভ্রমণের ক্ষেত্রে নন-এসি হোটেল সেবার ভ্যাট হারও বাড়তে পারে। বর্তমানে নন-এসি হোটেল সেবার ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

এ ছাড়া অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোর সময়ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মদের বিলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়। নতুন প্রস্তাব অনুসারে, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসতে পারে।

আমদানি, উৎপাদন ও সেবা পর্যায়ে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। যেমন আমদানি পর্যায়ে ফলের রসে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ, তামাকে ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ, সুপারিতে ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের কথা বলায় (টকটাইম) সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।
ভ্রমণে আবগারি শুল্ক বাড়তে পারে। ফলে আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বেড়ে যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রায় আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হতে পারে। আর বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ এবং সার্কভুক্ত দেশের বাইরে (এশিয়ার মধ্যে) ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হতে পারে।

অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য: ওদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। কারণ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের ডিউটি (শুল্ক) জিরো করে দিয়েছি। যেসব জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছি এগুলো আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ। বিমান ভাড়ার ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ছে- এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, অভ্যন্তরীণ বিমানে এখন লোকজন মোটামুটি চড়ে। তারা ২০০ টাকা বেশি দিতে পারবে না বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের ৫ মাস পর এই সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হচ্ছে- এ বিষয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা করার কারণটা হলো যে ছাড় দিয়েছি, সেটা হিসাব করে... কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে। আর আমাদের রাজস্ব গ্যাপ এত বেশি, আমি তো আর বড় করে ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং করে এগোতে পারবো না। সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কি না- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মনে হয় না কষ্ট হবে।’ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইটি খাতে আমরা বরাদ্দ কমাবো না বরং আমরা বৃদ্ধি করবো। কিন্তু আমাদের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ধার করে বেশিদিন চলা যায় না।’ জনগণ স্বস্তি পাচ্ছে কিনা- জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের স্বস্তি না পাওয়ার তো কোনো কথা না।’

বিশ্লেষণ ছাড়া ভ্যাট বাড়লে অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী পরিচালক ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, চাল, তেল, চিনি আমদানির শুল্ক কমিয়েও সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এনবিআর। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুচারু গবেষণা ও সুচিন্তিত বিশ্লেষণ ছাড়া ভ্যাট হার বাড়ানো হলে তা অর্থনীতিতে সঠিক ফলাফল নাও দিতে পারে। অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এই অবস্থায় ভ্যাট হার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে নিশ্চিতভাবেই।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য: অন্তর্বর্তী সরকারের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বলছেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ঘিরে প্রায় ৪-৫ মাস ধরে ব্যবসায় মন্দাভাব চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে তখনই কর বাড়ানোর মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ রেস্তরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ভ্যাট বাড়লে মানুষের ওপর জুলুম করা হবে। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসলে আমরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।  সব রেস্তরাঁ ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া হবে। পর্যটন নিয়ে এক উদ্যোক্তা বলেন, এমনিতেই পর্যটন খাত ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এর মধ্যে বিমানের টিকিটের দাম বাড়লে এ খাত আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা সবার সঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করবো।