আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের শর্ত মানতে গিয়ে যেন শিল্পের ক্ষতি না হয়

 আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের শর্ত মানতে গিয়ে যেন শিল্পের ক্ষতি না হয়

প্রথম নিউজ, ঢাকা : ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের দেওয়া সংস্কার দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। তবে খেয়াল রাখতে হবে তাদের শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে যাতে শিল্পের ক্ষতি না হয়। একই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি যেন বাধার মুখে না পড়ে।’

টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহিল রাকিব এক সাক্ষাৎকারে জাগো নিউজকে একথা বলেন।

আব্দুল্লাহিল রাকিব: ২০২৪ সালে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল তা ২০২৫ সালে অব্যাহত রয়েছে। বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থার সংকট আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে রাজনৈতিক সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং দেশের অর্থনীতির জন্য এটা খুবই জরুরি।

অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং বিনিয়োগে উৎসাহী করতে হলে একটি নির্বাচিত সরকার দরকার, যেটা এই মুহূর্তে আমরা মিস করছি। যথাযথ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি, তাদের ভূমিকা শ্রম সেক্টরে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য খুবই জরুরি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে ধরনের নির্দেশনা প্রয়োজন তা তারা পাচ্ছে না। ফলে নির্বাচিত সরকার জরুরি।

আব্দুল্লাহিল রাকিব: রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিতে হবে। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক বাড়ানোর। এটা ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। খেয়াল রাখতে হবে আইএমএফ কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের শর্ত মানতে গিয়ে যাতে শিল্পের ক্ষতি না হয়। তারা যে শর্ত দিয়েছে সেটা পরিপালন জরুরি, কিন্তু সেটা শিল্পের ক্ষতি করে নয়। যদি আমরা যথাযথ বিনিয়োগ না করতে পারি তাহলে ফ্যাক্টরি বন্ধ হবে, দেশে অস্থিরতা দেখা দেবে এবং বেকারত্ব বাড়বে।

সরকারের উচিত হবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে শিল্পের যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেগুলো গুরুত্বসহকারে এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাধান করা। তা না হলে ২০২৫ সালে যে ব্যবসায়িক সুযোগ রয়েছে তা আমরা কাজে লাগাতে পারবো না।

সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক বাড়ানোর। এটা ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। খেয়াল রাখতে হবে আইএমএফ কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের শর্ত মানতে গিয়ে যাতে শিল্পের ক্ষতি না হয়

বর্তমান সময়ে রপ্তানি পণ্যের কার্যাদেশ (অর্ডার) ভালো আছে। যদি আমরা তা গ্রহণ করতে না পারি, তাহলে সেক্টর ক্ষতির মুখে পড়বে। সেটা কাজে লাগানোর জন্য অবশ্যই সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে।

আব্দুল্লাহিল রাকিব: গত বছরের মতো এবছরও শ্রমিক অসন্তোষ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমরা দেখছি। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮ দফা দাবি মানার পরেও বেশ কিছু কারখানায় আমরা অতীতে অসন্তোষ দেখেছি। এর মানে হলো শুধু তাদের দাবি মেনে নেওয়ার মাধ্যমে অসন্তোষ নিরসন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার যথাযথ প্রয়োগ এবং সত্যিকারের অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কেউ যেন কোনো ধরনের নাশকতা করতে না পারে, ফ্যাক্টরি ভাঙচুর না করতে পারে সেজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আবার অসন্তোষ দেখা দিলে আমরা ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে পারবো না।

আব্দুল্লাহিল রাকিব: ক্রেতারা সব সময় সুযোগ খোঁজে। যত দেবেন তারা তত চাইবে। আমরা সুযোগ দিলে তারা সুযোগ নেবেই। আমাদের নিজস্ব দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং পণ্যের মান উন্নত করতে হবে। তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে আমাদের ব্যবসা ধরে রাখতে হবে।

সরকারের উচিত হবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে শিল্পের যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেগুলো গুরুত্বসহকারে এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাধান করা। তা না হলে ২০২৫ সালে যে ব্যবসায়িক সুযোগ রয়েছে তা আমরা কাজে লাগাতে পারবো না।

এক্ষেত্রে আমি ক্রেতাদের বলবো তারা যাতে তাদের ইথিক্যাল কমিটমেন্ট রক্ষা করে। আমি মনে করি তাদের দিক থেকে ইথিক্যাল কমিটমেন্টের অভাব রয়েছে। তারা সর্বদা ওয়েজের বাস্তবায়ন এবং ওয়েজের ইনক্রিমেন্ট চায়। কিন্তু প্রাইস বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের যে কমিটমেন্ট রয়েছে সেটা বিবেচনা করছে না। অনেক ক্ষেত্রে ওয়েট বাড়ানোর পরেও প্রাইস বাড়ায় না।

অনেক সময় ক্রেতারা বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞা করেন যে বেতন বাড়লে পণ্যের দাম বাড়াবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক ক্রেতারা শ্রমিকের বেতন বাড়ানোর পরেও তাদের যে কমিটমেন্ট থাকে পণ্যের মূল্য বাড়ানোয় তা রক্ষা করেন না।

আব্দুল্লাহিল রাকিব: শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কস্ট অব প্রোডাকশন তথা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। ২০২৩ সালের নতুন ওয়েজ বাস্তবায়নের ফলে ১৬০ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে। আরও অনেকগুলো বন্ধের পথে। অন্যদিকে, জ্বালানি খরচ বেড়েছে ২৮৬ শতাংশ, সুদের হার বাড়ার ফলে খরচ বেড়েছে বিনিয়োগের। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। ফলে ব্যবসায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকরা।

 বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি হওয়ার জন্য আমাদের মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তারা আগামী দিনের বড় শিল্প হবে। এক্ষেত্রে মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্প বিশেষ প্রণোদনা এবং বিশেষ ধরনের নীতিসহায়তা দিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের যে সাপোর্ট পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। সরকারের পলিসি সাপোর্ট যত ভালো হবে এবং ব্যবসার উপযোগী হবে অর্থনীতি তত ভালো হবে। ব্যবসায়ীরা আরও নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান করতে পারবে। নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের যত্ন নেওয়া।

বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি হওয়ার জন্য আমাদের মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তারা আগামী দিনের বড় শিল্প হবে। এক্ষেত্রে মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্প বিশেষ প্রণোদনা এবং বিশেষ ধরনের নীতিসহায়তা দিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে। এটা করতে পারলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হবে তেমনি আমাদের অর্থনীতির আকারও বড় হবে।