ডেঙ্গু: হাসপাতালে আর্তনাদ, রক্তের জন্য হাহাকার
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে মাঝবয়সী এক পুরুষ উদভ্রান্তের মতো পাঁয়চারী করছিলেন।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয় ১২ বছর বয়সী শিশু। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় শিশুটি লাইফ সাপোর্টে ছিল দুদিন। রক্তের জন্য রক্তদাতা সংগঠন ডোনেট ব্লাড বিডির কাছে ডোনারও চেয়েছিলেন রোগীর স্বজনরা। ডোনার ম্যানেজও হয়। কিন্তু ১৮ হাজারের নিচে নেমে যায় প্লাটিলেট। রোববার (২৩ জুলাই) মারা যায় শিশুটি।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে মাঝবয়সী এক পুরুষ উদভ্রান্তের মতো পাঁয়চারী করছিলেন। তিনি মোবাইলে কথা বলছিলেন একের পর এক নম্বরে। কথা শুনে বোঝা গেলো, তার সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি। গত সাতদিনে তার সন্তানের রক্তের প্লাটিলেট কমে ১২ হাজারে এসে ঠেকেছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, আজ রাতের মধ্যে প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে না পারলে রোগী ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে পড়ে যাবে। ঢাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন নামে এই ভদ্রলোক একাধিক রক্তদাতা সংগঠন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেও সোমবার (২৪ জুলাই) দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন রক্তদাতা পাননি।
মিটফোর্ড হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মোর্শেদা বেগমের প্লাটিলেট কমে ঠেকে সাত হাজারে। ও পজিটিভ রক্তের জন্য তার আত্মীয়-স্বজন বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করলেও রক্তের সন্ধান মেলেনি। পরে অনেক চেষ্টার পর একজন ডোনার পাওয়া যায়। তবে একজনের প্লাটিলেট নিলেও মোর্শেদা বেগম মারা যান।
রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুরোগ তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ায় রক্তের সংকট দেখা দিয়েছে ব্লাড ব্যাংকগুলোতে। পাশাপাশি রক্তের চাহিদাও বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীর স্বজনরা রক্তের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের কেউ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, কেউ ছুটছেন ব্লাড ব্যাংকগুলোতে। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে রক্ত জোগাড় করছেন। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় যে কোনো সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ চাহিদা তৈরি হয়েছে রক্তের। বিশেষ করে নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপের রক্ত রীতিমতো দুষ্প্রাপ্য এখন।
একই অবস্থা দেখা যায় রাজারবাগ ব্লাড ব্যাংক, বাঁধন, কোয়ান্টাম, রেডক্রিসেন্ট, সন্ধানীসহ রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহকারী প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই। তারা বলছেন, নিয়মিত রক্তদাতার বাইরেও অনেকে রক্ত দিতে এগিয়ে আসছেন, তবে তাদের সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের স্বল্পতা এমনিতেই থাকে, ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে একজন রোগীর এক ব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য চার ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, রাজধানীর অনেক হাসপাতালেই শয্যা ফাঁকা নেই। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে অনেকেরই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে রক্ত। ডেঙ্গু আক্রান্তদের রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আক্রান্ত হওয়ার তৃতীয় বা চতুর্থ দিন থেকে কমতে থাকে রোগীর প্লাটিলেট। হঠাৎ করেই নেমে আসছে ২০-৩০ হাজারের নিচে। ২০ হাজারের নিচে প্লাটিলেটের সংখ্যা নেমে এলে কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে রোগীর। এতে অনকে সময় রোগী মারা যায় ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে।
রক্তদাতা সংগঠন বাঁধনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জোনের সভাপতি মো. ইউসুফ হোসেন বলেন, বাঁধন একটি স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনামূল্যে বাঁধন রক্ত সরবরাহ করে। আগে আমাদের কাছে যত সংখ্যক ফোন আসতো তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফোনকল আসছে বর্তমানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাদের আত্মীয় কিংবা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মীয়রাও আমাদের কাছে প্লাটিলেটের জন্য ফোন করছেন। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।
রক্তদাতা সংগঠন ডোনেট ব্লাড বিডির নজরুল ইসলাম বলেন, আগের চেয়ে বর্তমানে তিন থেকে চারগুণ ফোন কল আসে ডোনারের জন্য। যাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। প্লাটিলেট যখন ২০ হাজারের নিচে চলে আসে তখন রোগীদের স্বজনরা কান্নাকাটি করে আমাদের কাছে ফোন করেন ডোনারের জন্য। কিন্তু বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে ডোনার খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। যারা নিয়মিত রক্তদান করেন তাদের বেশিরভাগ ইতোমধ্যে কাউকে না কাউকে রক্তদান করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রক্তের ডোনার খুঁজে রোগীদের সহযোগিতা করেন হিমু। তিনি বলেন, আগে সারাদিনে ১৫ থেকে ২০ জন ডোনার ম্যানেজ করে দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে দিনে ৫০ থেকে ৬০ জন ডোনার ম্যানেজ করে দিতে হয়। ক্রিটিক্যাল রোগীদের ডোনার না পাওয়া গেলে মেহজাবীন-শবনম ফারিয়াদের মতো সেলিব্রেটিদের ফেসবুক থেকে রক্ত চেয়ে পোস্ট করা হয়। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, স্বাভাবিকভাবে বর্তমানে ডেঙ্গুরোগী বেড়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেই বেশিরভাগ রোগী ও রোগীর আত্মীয়রা মনে করেন রক্ত প্রয়োজন। তবে সব ডেঙ্গুরোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন হয় না।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যু হওয়ার মূল কারণ রক্ত থেকে জলীয়বাষ্প বেরিয়ে যাওয়া। ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কমে যাওয়া ভয়ের কারণ নয়। ডেঙ্গুর একটি জটিলতা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। অনেক অনভিজ্ঞ চিকিৎসক ভয়ে থাকেন এবং তারা মনে করেন ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হলে রোগী মারা যাবে রক্তপাত হয়ে। তবে এ ঘটনা লাখে একটি ঘটে। সুতরাং, আমরা বলি কখনোই প্লাটিলেট দেওয়ার দরকার নেই। প্লাটিলেট যদি ১০ হাজারেও নেমে আসে তারপরেও দেওয়ার দরকার নেই। একমাত্র তখনই প্লাটিলেট দিতে হবে যদি কারও রক্তপাত হয়। এ বিষয়ে সব চিকিৎসককে অনুরোধ জানাবো জাতীয় নির্দেশনা অনুসরণ করতে।
ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, অনেক সময় রোগীর প্লাটিলেট ৫০ হাজার থেকে কমে ৪০ কিংবা ৩০ হাজারে নেমে এলে রোগীর স্বজনেরা চিকিৎসকদের প্লাটিলেটের জন্য অনুরোধ করে। এমন সময় চিকিৎসকরা মনে করেন রোগী মারা গেলে হয়তো তার দোষ হবে। এজন্য চিকিৎসকরা রোগীর স্বজনদের কথা শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্লাটিলেট লিখে দেন। এটি করা উচিত নয়। আমরা সব সময় চিকিৎসক, নার্স ও রোগীর আত্মীয়দের প্লাটিলেট নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ করি।
অনেক সময় রোগীর প্লাটিলেট ৫০ হাজার থেকে কমে ৪০ কিংবা ৩০ হাজারে নেমে এলে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের প্লাটিলেটের জন্য অনুরোধ করে। এমন সময় চিকিৎসকরা মনে করেন রোগী মারা গেলে হয়তো তার দোষ হবে। এজন্য চিকিৎসকরা রোগীর স্বজনদের কথা শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্লাটিলেট লিখে দেন। এটি করা উচিত নয় ডেঙ্গুরোগীরা সুস্থ হওয়ার পরও তাদের বেশকিছু বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এর মধ্যে ডেঙ্গুরোগীরা সুস্থ হওয়ার পরবর্তী ছয়মাস কাউকে রক্ত দিতে পারবেন না বলেও জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি ডেঙ্গুরোগীকে সুস্থ হওয়ার পর আরও দশদিন মশারির ভেতরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, রক্তের মাধ্যমে ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়াতে পারে।