ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি, বেড়েছে নাগরিক দুর্ভোগ
চসিক মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছর
প্রথম নিউজ, ঢাকা: চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদের বেশিরভাগ সময় পার হয়ে গেলেও তার ইশতেহারের দেওয়া অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। বর্ষাকালে নগরবাসী এখনো ডুবে থাকে কোমর থেকে গলা পানিতে। মোড়ে মোড়ে যানজট যেন চট্টগ্রামের নিত্যদিনের ঘটনা।
আবার কামান দাগিয়ে ঠেকানো যায়নি মশার উপদ্রবও। খাল, নালা ও ফুটপাত থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ যথাযথভাবে ঠেকানো যায়নি। আবর্জনা ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি করার ঘোষণা দিয়েছিলেন মেয়র রেজাউল। তবে তার এসব শুধু অঙ্গীকার ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সবমিলিয়ে নগরবাসীর সেবা দানকারী এই প্রতিষ্ঠানের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে নাগরিক পর্যায়ে।
জানা গেছে, ইশতেহারে ফলাও করে জলাবদ্ধতা নিরসনের অঙ্গীকার দিয়েছিলেন মেয়র রেজাউল। তবে সর্বশেষ বর্ষায়ও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি ছিল নাজুক। স্থানীয়রা বলছেন, অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে পানি জমে থাকার রেকর্ড হয়েছে গত বছর। খোদ মেয়রের বাসা ডুবেছিল হাঁটু সমান পানিতে। যথাযথভাবে ড্রেন পরিষ্কার না করায় নগরের বিভিন্ন স্থান ময়লা পানিতে তলিয়ে গেছে। নানা সময়ে নগরের চকবাজার ও জিইসি মোড় জঙ্গি শাহ মাজার এলাকার সড়কে উঠেছে ড্রেনের পানি।
মেয়র রেজাউলের মেয়াদের তিন বছরেও মশার উপদ্রব থেকে রেহাই পাননি নগরবাসী। বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিটি কর্পোরেশন কর্মীরা নিয়মিত খাল-নালা পরিষ্কার না করায়, এগুলো মশার প্রজননের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। এতে করে চট্টগ্রামের ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৯৫৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১০৫ জন। মানুষ ডেঙ্গুতে নাকাল হতে থাকলেও মশকনিধন কার্যক্রম ছিল ঢিমেতালে। এমনকি তড়িঘড়ি করে এক ছাত্রলীগ নেতার কাছ থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বারবার ওষুধ কেনে সিটি করপোরেশন। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে তার প্রমাণ পায় দুদক।
মেয়র রেজাউলের আমলের তিন বছরই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। তার আমলের শুরুতে ২০২১ সালে আক্রান্ত সংখ্যা ছিল ২৭১। ২০২২ সালে সেটি রেকর্ড ছাড়িয়ে ৫ হাজার ৪৪৫ গিয়ে ঠেকে। অথচ মেয়র রেজাউলের আগের বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তে সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭।
আবার ঘর ভাড়ার ওপর অতিরিক্ত হোল্ডিং ট্যাক্স নেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা নিয়েও আন্দোলনে উত্তাল ছিল চসিক। দেশের অন্য সিটি কর্পোরেশনে আয়তনের ওপর হোল্ডিং ট্যাক্স দিলেও চট্টগ্রামে দিতে হচ্ছে ঘর ভাড়ার ওপর। সেক্ষেত্রে অনেক বাড়িওয়ালার হোল্ডিং ট্যাক্স বেড়েছে পাঁচগুণ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত। এ নিয়ে লাগাতার আন্দোলনও করেছে করদাতা সুরক্ষা পরিষদ নামে একটি সংঘটন। যদিও মেয়রের দাবি, হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে মালিকদের আপিল করার সুযোগ আছে। আপিল করলে হোল্ডিং ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে আনা হয়েছে।
জানতে চাইলে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি নুরুল আবছার বলেন, ‘ভাড়ার ওপর হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের সিদ্ধান্তটি স্থগিত ছিল। মেয়র রেজাউল পর ৪-৫ বার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন স্থগিতাদেশ তুলে নিতে। শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে। রাতারাতি ৫ হাজার টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স হয়ে গেছে ২ লাখ টাকা। এনিয়ে কথা বলায় আমাকে মামলার আসামিও হতে হয়েছে। ১৮ দিন কারাগারে ছিলাম। এখনও ওই মামলা চালাতে হচ্ছে।’
এদিকে নিয়মিত সংস্কার না করায় বেহাল অবস্থা হয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কের। নগরের শমশের পাড়া হয়ে বহদ্দরহাট পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিকে অবহেলায় পড়ে দীর্ঘদিন ধরে। খানাখন্দে ও ধুলাবালির কারণে অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। শুধু শমশের পাড়ার সড়ক নয় নগরীর চকবাজার, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, সদরঘাট, আগ্রাবাদ কাট্টলি ও পতেঙ্গা এলাকায় সড়কেও রয়েছে অগণিত খানাখন্দ।
শমশের পাড়া এলাকার বাসিন্দা খাইরুল আবরার বলেন, চট্টগ্রাম শহরের এতো কিছু হচ্ছে। অনেক জায়গায় ভালো রাস্তার ওপর আবারও কার্পেটিং করা হয়েছে। অথচ বছরের পর বছর এই সড়কটি কোনো ধরনের সংস্কার ছাড়াই পড়ে আছে। এনিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজনের) সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সিটি কর্পোরেশন একটি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। তাদের সেবার মান তলানিতে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রীতিমতো বিশৃঙ্খলা। হোল্ডিং ট্যাক্সের নামে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। আমার জানামতে হোল্ডিং ট্যাক্সের একটি অংশ ব্যয় হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। এখন আবার আলাদা করে বর্জ্যের জন্য জনগণের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো চালাচ্ছে সবকিছু। মশার প্রকোপে জনজীবন অতিষ্ঠ। সিটি কর্পোরেশন প্রধান কাজগুলো করতে পারছে না। সার্বিক বিষয়ে জানতে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।