আমাগেরে একটা পাকা স্কুল ঘর হলি ভালো হইতো
সরকারের কাছে কই আমাগেরে যেন একখান পাকা স্কুল করে দেয়। এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের দুর্গম চর কুশাহাটার আয়শা খাতুন (০৮)।
প্রথম নিউজ, রাজবাড়ী: আমাগেরে একটা পাকা স্কুল হলি ভালো হইতো। আমরা গাছতলায় রোদ্দুরের মধ্যি ক্লাস করি। খোলা জায়গায় বসে থাকতে আমাগের অনেক কষ্ট হয়। আবার দেওয়া আইলে আমরা ভিইজা যাই। সরকারের কাছে কই আমাগেরে যেন একখান পাকা স্কুল করে দেয়। এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের দুর্গম চর কুশাহাটার আয়শা খাতুন (০৮)।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত কুশাহাটা গ্রামটি। দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পদ্মার চরের চার দিকে থই থই পানিতে ঘেরা কুশাহাটা গ্রাম। চার দিক নদীবেষ্টিত হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে নৌকায় পারাপারই এখানকার মানুষের একমাত্র ভরসা। কোনো রাস্তা না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে মাঠের পর মাঠ পায়ে হাঁটা ছাড়া যাতায়াতের অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। ওই চরের আড়াই শতাধিক শিশু শিক্ষাবঞ্চিত। এছাড়া স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানিসহ সব নাগরিক সুবিধা থেকে অনেক দূরে এই এলাকার মানুষ।
জানা যায়, প্রায় ২৫ বছর আগে দৌলতদিয়ার কুশাহাটা এলাকাটি পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়। তখন কুশাহাটার কয়েক হাজার পরিবার ভিটেমাটিসহ সহায়-সম্বল হারিয়ে বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। ওই সময় ১২০টি পরিবার মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার কানাইদিয়া চরে বসতি স্থাপন করে। ২০১৩ সালে আবার কুশাহাটা চর জেগে ওঠে এবং কানাইদিয়া চরে পদ্মার ভাঙন দেখা দেয়। তখন ওই ১২০টি পরিবার ১৩ বছর পর আবার কুশাহাটায় এসে বসতি স্থাপন করে। বসতি স্থাপনের পর প্রায় ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও তারা পাচ্ছে না কোনো ধরনের সামাজিক বা নাগরিক সুবিধা। এছাড়া চরের শিশুদের পড়ালেখা করার জন্য নেই কোনো বিদ্যালয়। বাধ্য হয়ে গাছতলায় চলে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কুশাহাটা চরের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ২০১৭ সালে পায়াক্ট বাংলাদেশ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ওই চরে ‘কুশাহাটা পায়াক্ট বাংলাদেশ প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নাম দিয়ে একটি স্কুলঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিশুদের পাঠদানের জন্য চরের স্থানীয় এসএসসি পাস যুবক মো. ওয়াজউদ্দিন সরদার ও তার স্ত্রী রওশনারা বেগমকে সমান্য বেতনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চার বছর পর ঝড়ে স্কুলঘর ভেঙে পড়ে। তারপর থেকে ওয়াজিউদ্দিন এর বাড়ির আঙিনায় গাছতলায় চট বিছিয়ে কোনোমতে চলে আসছে পাঠদান কার্যক্রম। বর্তমানে ওই স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২২ জন।
শিক্ষক ওয়াজউদ্দিন বলেন, ২০১৭ সালে পায়াক্ট বাংলাদেশ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে এই দুর্গম চরাঞ্চলে শিশুদের পাঠদানের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি সহায়তা ও অনুদান না থাকায় স্থায়ী কোনো ঘর নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করেই আমি আমার বাড়ির আঙিনাতে শিশুদের পড়াই। এই চরের মানুষ দরিদ্র হওয়ায় তারা যে যা পারেন আমার পারিশ্রমিক হিসেবে তাই দেন। এই সামান্য টাকায় আমারও সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যায়। তারপরও দুর্গম চরের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
পায়াক্ট বাংলাদেশ দৌলতদিয়া শাখার সুপারভাইজার শেখ রাজীব জানান, পায়াক্ট বাংলাদেশে যখন শিক্ষা প্রকল্প ছিল, তখন কুশাহাটায় কোমলমতি শিশুদের জন্য একটা স্কুলঘর করে দেওয়া হয়। কিন্তু গত বছর ঝড়ে তা ভেঙে পড়ে।বর্তমানে শিশুরা গাছতলায় চট বিছিয়ে পড়ালেখা করে। তাদের একটি পাকা স্কুলঘর খুব প্রয়োজন। আমাদের সংস্থার একার পক্ষে পাকা দালান করে দেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজনীয়। একটি পাকা ঘর হলে এই চরের শতশত শিশুর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়বে।
কুশাহাটা চরের স্কুলছাত্র রাকিবে মা সালেহা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। স্কুলের পাকা বিল্ডিং না থাকায় গাছতলায় বসে ক্লাস করে। প্রত্যেক মাসে স্যারকে দুইশ টাকা দিতে হয়।আমাদের জন্য এই টাকাই তো অনেক বেশি। সরকারিভাবে যদি এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতো, তাহলে এই চরের অনেক শিশুই পড়ালেখার সুযোগ পেত।
গোয়ালন্দ রাবেয়া ইদ্রিস মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কাদের শেখ বলেন, পায়াক্টের মাধ্যমে শিক্ষক ওয়াজউদ্দিন ও তার স্ত্রী চরের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যা খুবই প্রশংসনীয়। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। সেখানে সরকারিভাবে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা জরুরি। সেইসঙ্গে চরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করাও খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়ার জন্য আমি সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
গোয়ালন্দ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন বলেন, কুশাহাটার চরে এক সময় স্কুল ছিল। কিন্তু নদীভাঙনের কবলে পড়ে স্কুলটি দেবগ্রামে ইউনিয়নে স্থানান্তর করা হয়। কুশাহাটা এলাকায় সারা বছর পানিতে আটকে থাকায় সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা খুবই নাজুক পর্যায়ে আছে। আমরা উপর মহলে ইতোমধ্যে কথা বলেছি। শিগগিরই কুশাহাটায় শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোস্তফা মুন্সি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কুশাহাটা চরে একটি স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে জমি কিনে মাটি ভরাট করেছি। শিগগিরই কাজ শুরু করব।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews