অর্থ বিভাগের ‘কর্মসম্পাদন’ প্রতিবেদন: ঋণ পরিশোধ ও ব্যয় হ্রাস প্রধান চ্যালেঞ্জ

অর্থ বিভাগের ‘কর্মসম্পাদন’ প্রতিবেদন: ঋণ পরিশোধ ও ব্যয় হ্রাস প্রধান চ্যালেঞ্জ

প্রথম নিউজ, ঢাকা : ঋণ ও সুদ পরিশোধ ব্যয়ে বড় অঙ্ক কমিয়ে আনা এবং সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে অর্থ বিভাগ। এছাড়া অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক রাখাও চ্যালেঞ্জ হিসাবে শনাক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায় অর্থ বিভাগ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘কর্মসম্পাদন’ প্রতিবেদনে এসব চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘কর্মসম্পাদন’ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিক কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতিসাধনের ওপর জোর দিতে হবে।

ওই প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ৬টি কার্যক্রমকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, সরকারের ঋণগ্রহণ সহনীয় রাখতে বাজেট ঘাটতি ৪ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা এবং রাজস্ব, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার নীতির সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে মধ্য মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো হালনাগাদ করা। এছাড়া প্রতিবছর বাজেটে আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক করা। যাতে প্রকৃত আয় ও ব্যয়ের অঙ্ক বাজেটে ঘোষিত অঙ্কের মধ্যে ব্যবধান কম থাকে।

সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে ‘কর্মসম্পাদন’ চুক্তি স্বাক্ষরের পর এটি বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কর্মসম্পাদন চুক্তিতে সাধারণত পুরো এক বছরের জন্য একটি মন্ত্রণালয় কোন কোন লক্ষ্য অর্জনে কী ধরনের কাজ করবে, এর ধারণা দেওয়া হয়। পাশাপাশি এসব কাজ করতে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র সচিব (অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যে করণীয়গুলো দেখানো হয়, সেগুলো অর্জন হয় কি না, এর একটি মূল্যায়ন হওয়া উচিত। যেসব চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়েছে, অর্থনীতিতে সেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

তবে এর বাইরে আরও একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতির মধ্যে একটি সমন্বয় করে কার্যক্রম চালানো। তিনি আরও বলেন, ফিসক্যাল পলিসিতে দুটি দিক আছে, ব্যয় ও আয়ের খাত। ব্যয়ের বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এখন মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতির মধ্যে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে। সেটির যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) কর্মসম্পাদন প্রতিবেদনে অর্থনীতির ‘সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার’ কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, সামষ্টিক অর্থনৈতিক চালকগুলোর প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়ার উন্নতিসাধন, নগদসহ সার্বিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানো, আর্থ-ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, সরকারি ব্যয়ে যৌক্তিককরণ এবং কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ।

ঋণ ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ হিসাবে উল্লেখ করার কারণ হিসাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চলতি এবং আগামী দুটি অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। ফলে অর্থনীতিতে বাড়বে ঋণ পরিশোধের চাপও।

জানা যায়, চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৯০ হাজার ৭০০ কোটি এবং দেশীয় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া কিছু মেগা প্রকল্পের মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এবং সেই বছরে ৬২ হাজার কোটি টাকা কিস্তিু হিসাবে ব্যয় হবে। ঋণ পরিশোধের চাপ নিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একটি হিসাবে বলা হয়েছে, ২০৩৪ সাল পর্যন্ত এ চাপ অব্যাহত থাকবে।

এদিকে ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিরূপণ করতে গিয়ে সরকারি ব্যয়ে ফের লাগাম টানা হয়েছে। এর আওতা ইতোমধ্যে ‘থোক বরাদ্দ তহবিল’-এর অর্থব্যয়, সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণ, মন্ত্রণালয় ও সংস্থার জন্য যানবাহন ক্রয় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্ধ থাকবে নতুন স্থাপনা নির্মাণও। অর্থসাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ, পেট্রোল, অয়েল লুব্রিকেন্ট ও গ্যাস-জ্বালানির মোট বরাদ্দের ২০ শতাংশ ব্যয়ও স্থগিতের আওতায় আনা হয়েছে।

সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের সংশ্লিষ্ট খাতে টাকা খরচে মিতব্যয়ী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে ‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়’ বলা হয়, টেকসই ঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা হবে। অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। এছাড়া দক্ষ আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা করা হবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেনশন মজুরিসংক্রান্ত কার্যক্রম আটোমেশনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সও কাঙ্ক্ষিত আকারে বাড়ানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের সরবরাহ না বাড়ানো গেলে বিদেশি ঋণ ঘিরে সংকট জোরালো হতে পারে-এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।