রাজনীতির বাসর রাত

রাজনীতির বাসর রাত

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বর্তমান বিশ্বে প্রতিটিমানুষ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। রাজনীতি করেনা বলে যিনি দাবী করেন তিনিও রাজনীতির আওতামুক্ত নহে। রাজনীতির প্রভাবের আওতার মধ্যেই প্রতিটি শিশু জন্মগ্রহণ করে । সোনার চামচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুটিকেও বাংলাদেশে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই জন্মগ্রহণ করতে হয়। এদেশের প্রায় সকল মানুষই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই মৃত্যু বরণ করছে। সরকার গালভরা বুলি আওড়িয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, মানুষের জনপ্রতি আয় (ইনকাম) বৃদ্ধি পেয়েছে যা সত্যোর অপলাপ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সমুদয় অর্থ সরকারী ঘরনার এক শ্রেণীর মানুষের হাতের মুঠায় মুষ্ঠিবদ্ধ হয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের ভাগ্যোর কোন পরিবর্তন হয় নাই, বরং নিম্নমূখী। বস্তিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা। সরকার নিজেও ঋণের উপরে চলছে। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে যার শিরোনাম ছিল “সরকারকে ঋণ দিয়ে বিপদে ব্যাংকগুলো” (সূত্র: তাং- ০৩/১০/২০২১ ইং)।

দেশের গণমানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপের জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়া বা অর্থনীতিবিদের মন্তব্য বিশ্লেষন করার প্রয়োজন পড়ে না। গ্রাম গঞ্জে বিভিন্ন পরিবারের খোজ খবর নিলেই বুঝা যাবে যে, কতজনের নূন আনতে পানথা ফুরিয়ে যায় বা শতকরা কয়টি পরিবার স্বচ্ছলতার মূখ দেখছেন? প্রতিটি পরিবারে কতজন উপার্জনক্ষম মানুষ রয়েছে? এবং বেকারত্ব জীবন যাপন করছেন কত জন? ধরা যাক, পরিবারের ৫ জনের মধ্যে একজন যদি উপার্জন করে এবং বাকীরা যদি নির্ভরশীল হয় তবে পরিবারটিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল বলা যাবে কি? আমি মনে করি গোটা বাংলাদেশে গ্রাম গঞ্জে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত প্রতিটি পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা একই ধরনের। তবে সরকারী ঘরনার লোকেরা যারা এম.পি’দের ছত্র ছায়ায় আছে তাদের চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, জমিদখল, ব্যবসা দখল প্রভৃতি মিলিয়ে স্বচ্ছলতার অবস্থা চলমান রয়েছে, সমস্যায় রয়েছে যারা সরকারী ঘরনায় পৃষ্ঠপোষকতা পায় নাই। অন্যদিকে সরকারী দল করলে সকলেই যে দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাবে তাহাও নিশ্চিত নহে। কারণ প্রতিটি এলাকায় এম.পি’দের বলয়ে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে উঠেছে এবং সে বাহিনীই নিয়ন্ত্রন করছে সংশ্লিষ্ট এলাকা এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর।

ভোটাধিকার, স্বাধীনতার সুফল পাওয়ায় অধিকার, মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, জন্মগত অধিকার, মানবাধিকার সব মিলিয়ে দেশের আপামর মানুষ কি নিজ অধিকার প্রয়োগ করতে পারছে? দল মত নির্বিশেষে দেশের মানুষ কি স্বাচ্ছন্দে বা নিরাপত্তায় রয়েছে যতটুকু ভালো থাকার বুলি তোতা পাখির মত বলে যাচ্ছে সরকারী দল ও দলীয় ঘরনার বুদ্দিজীবিরা, বিশেষ করে কোলকাতা মনস্ক বুদ্দিজীবিরা। বৃটিশ আমলেও বৃটিশ সকারের অত্যাচার নির্যাতন কে সমর্থন করে কথা বলার লোকের অভাব ছিল না এবং সে ধরনের লোকেরা অভাব এখনো নাই। “রায় বাহাদুর”, “খান বাহাদুর”, “স্যার” প্রভৃতি উপাধি দিয়ে ভারতীয় অনেক প্রভাবশালীকেই বৃটিশরা তাদের খয়ের খা (চামচা) বানিয়ে ছিল। এ ধরনের বুদ্দিজীবি আউব খা বা ইয়াহিয়া খানের পক্ষেও কম ছিল না। “সত্য” যখন “স্বার্থের” নিকট হার মানে তখন নিজের নিরাপত্তার কারণেই মানুষ বিশেষ করে সূযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগী মানুষ “হক” কথা বা “সত্য” কথা বলা থেকে বিরত থাকে এবং এ সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে যেন দিন দিন বৃদ্ধি হয়েই চলছে। সম্প্রতিকালে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে জ্যামিতিক হারে। 

রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। রাজনীতির কারণেই রাষ্ট্র ভাষা বাংলা হওয়ার দাবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় প্রভিশন সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছে। আবার রাজনীতির কারণেই সংবিধান থেকে উক্ত প্রভিশন উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তবে সংবিধান সংশোধনের কোন প্রভিশনটি ইতিহাসের আস্তাকুরে নিক্ষিপ্ত হবে তা ভবিষ্যতই বলে দিবে। তদুপরি তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরোধীতা করার মানুষের অভাব হচ্ছে না। রাজনীতির কারণেই স্বাধীনতার পর পর একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, হালে দেশ ও রাষ্ট্র ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে সে দিকেই যাচ্ছে, গণতন্ত্র থাকছে শুধু মূখে মূখে ও বই পুস্তকের পাতায়।  

রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাকে বুঝায় তবে ক্ষমতাসীন দল তাদের দৃষ্টিতে ভুল করছে বলে মনে হয় না। ইংলেন্ডে একটি প্রবাদ রয়েছে যে, “কিং কেন নট ডু রং।” অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা যখন কোন কাজ করে তখন মনে করে যে তারা কোন ভুল করে নাই। যখন ভুল ধরা পড়ে তখন আর শুধরানোর সময় থাকে না। প্রেক্ষাপট বলে যে, রাজনীতি এখন চলে গেছে ব্যাংক লুটেরা ব্যবসায়ী, আমলা ও দেশী বিদেশী গোয়েন্দাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে রাজনীতির মজা দলীয় নেতাকর্মীরা এখন সেভাবে পাচ্ছে না, ফলে হতাশার ব্যাথা বেদনা নিয়েই রাজনীতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে সে সকল রাজনৈতিক কর্মী যারা শত বঞ্চনার মধ্যে রাজনীতি প্লাটফর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চায়। একটি সময় ছিল যখন একটি দল সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রথম কাতারের বিবেচনায় রাখতো। এখন সে মন মানসিকতার বিলুপ্তি ঘটেছে। মূখে মূখে অনেকেই বলে যে, সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, যা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবতায় এর কোন প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্বাধীনতার সুফল যেমন জনগণের গোরদরজায় পৌছে নাই, তেমনি রাজনীতির মূল্যবোধ বা প্রকৃত স্বাদ দলগুলি তাদের বৃষ্টিতে ভেজা ও রুদ্রে পোড়ানো ত্যাগী নেতা কর্মীদের দিতে পারে নাই। দলগুলি ক্ষমতায় থাকলে চলে ভাগবাটোয়ারা প্রস্তুতি, বিরোধী দলের হলে থাকতে হয় দৌড়ের উপরে। ফলে একজন দৃঢ়চেতা, মানবিক জ্ঞান সম্পন্ন দেশপ্রেমিক কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার কর্মসূচী বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ সমস্ত কারণেই দলে যখন দূর্যোগ আসে তখন তা উত্তরনের রাস্তা খোজা কঠিন হয়ে পড়ে। 

রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতার কি পরিবর্তন ঘটেছে? নাকি জনগণ বিভিন্ন ভাবে প্রতারিত হয়ে রাজনীতি বিমূখ হচ্ছে এবং এ ফয়দাটি লুটে নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। এ বিষয়গুলিও মাথায় রেখে রাজনীতি বিমূখতার কারণ অনুসন্ধান করাই হতে হবে বিরোধী রাজনীতির বর্তমানে প্রধান কর্মসূচী। রাজনীতির অধিক্ষেত্র হলো জনগণ, অতএব জনগণের মন মানসিকতার মাপকাঠি বিচার বিশ্লেষণ এখন সময়ের দাবী। অন্যদিকে রাজনীতি অর্থ, আমলা ও গোয়েন্দাদের কারসাজি থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতির যে একটি নিজস্ব স্বাদ রয়েছে তাহাও জনগণ ভোগ করতে পারছে না এবং পারবে না।

প্রতিটি মানুষই দোষে গুনের মানবিক বৈশিষ্ট নিয়ে গঠিত। জাতি হিসাবেও আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এ দেশের মাটি কখন কোন রং ধরে তাহাও আঁচ করতে সময় লাগে বটে, তবে চূড়ান্ত খেলায় “প্রকৃতি” তার স্বাভাবিক রূপের বাহিরে যায় না। এ দেশে যেমন জন্ম হয়েছে সিরাজ দৌল্ল্যাহ তেমনি জন্ম হয়েছিল মীর জাফরের। এ ধরনের বহু উপমা দেয়া যাবে যারা জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার পরও সাময়িক জয়লাভ করেছে, কিন্তু শেষটা ভালো হয় নাই, হয়েছে অপমানজনক পরিনতি।

একটি “বাসর রাত” নাকি একজন মানুষের সারাজীবনের অপেক্ষা। এ রাতের সংস্কৃতি হলো সত্য মিথ্যার সকল প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে কোনভাবে একে অপরকে সন্তোষ্ট করার চেষ্টা করা। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। চাঁদের স্নিন্ধ আলোতে দেয়া সে প্রতিশ্রুতি এক সময় ঝলসানো রুটিতে পরিণত হয়, যা হয় না তা হলো হাতে গোনা মুষ্ঠিমেয়। তখন আশা প্রত্যাশা যেমন মূখ থুপড়ে পড়ে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের দেশের রাজনীতিও চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। অতি আশা নিষ্ফলে পরিনত হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনাকে অবমূল্যায়িত করছে তারাই যারা স্বাধীনতার নেতৃত্বের দাবীদার। 

বিভিন্ন কারণে জনগণ বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সময়ের সন্ধিক্ষনে জাতির প্রয়োজনে জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস থাকলেও অনেক সময় বিষয়টি সময় সাপেক্ষ বটে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন, যা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া এ দেশে মোটেও সম্ভব নয় এবং ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভবনা নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। কথাটি শুনতে ভালো লাগলেও সার্চ কমিটিও প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার ভুক্ত। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ বলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অপরীসিম অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। ফলে যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপান্ন। ক্ষমতার কাছে ভিকটিম হচ্ছে জনগণ। আশাহত হচ্ছে জনগণ, ঠিক বাসর রাত্রের “প্রতিশ্রুতি” রনে ভঙ্গ করার মত।  

লেখক

অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন) 

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom